বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, এই পাখিটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ব্লাকবেকড ফর্কটেইল’ (Black-backed Forktail)। দুইভাগে ভাগ হলে গেলে সেটাকে বলে ‘ফর্ক’ (Fork)।
‘এ পাখিটা একমাত্র সিলেটেই আছে। বলা যেতে পারে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম। যেখানে পাহাড়ি জঙ্গল আছে সেখানেই তার বসবাস এবং সে শুধু পানিতেই থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পাহাড়ি ঝরনা ছাড়া কোথাও খুঁজে পাবেন না তাকে। একমাত্র পাহাড়ি ঝরনা যেটা গাছপালাআবৃত প্রকাশ্য আলোতে সে কখনো থাকবে না। গাছাপালায় ঢাকা একেবারে টানেলের মতো ওখানে যে কোনো পাহাড়ি ছড়ায় ঢুকে দেখেন, যখন ঝরঝর করে পানি পাত্রের ওপর দিয়ে পড়ে যাচ্ছে আর ওপরে দু’পাশ দিয়ে গাছ এসে ঢেকে আছে এরকম জায়গাতেই কেবল ওকে পাবেন। আর কোথাও সে থাকে না। এই একটা মজার পাখি যেটা সবসময়ই সাদা কালো। কালো মানে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের মতো নীলচে-কালো। শরীরের অর্ধেকটা সাদা। ডোরাকাটা। ’
পাখিটি প্রজাতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের বাংলাদেশে শুধুমাত্র পূর্বদিকে যেখানে আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল অর্থাৎ সিলেট ডিভিসন এবং চিটাগাং ডিভিসন এই দুই জায়গায় ছাড়া আরও কোথাও নেই। আমাদের দেশে এই একটি প্রজাতির রয়েছে। তবে আরও ১টি প্রজাতি দেখা গেছে দু-একবার। গত পাঁচ বছরে আমি দু-একবার দেখা প্রজাতিকে একবারও দেখি নাই। সুতরাং এই একটি মাত্র প্রজাতি আছে; যার নাম কালাপিঠ-চেরালেজ।
ইনাম আল হক বলেন, মজার ব্যাপার হলো, চেরালেজ পাখিগুলো মাত্র সাতটি প্রজাতি পাখি আছে পৃথিবীতে এবং তার সবই এই এলাকার। মানে আমাদের এই হিমালয় পর্বত থেকে যেখানে যেখানে হিমালয় পর্বত গেছে তার থেকে শুরু করে একটু নিচে পাহাড়ি অঞ্চল যে জায়গা অর্থাৎ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এই জায়গাগুলো আর কোথাও নাই পৃথিবীতে। এরা অত্যন্ত আঞ্চলিক। ভিয়েতনাম, চীনে এই ৭টি প্রজাতির ভেতর ২ থেকে ১টি প্রজাতি আছে। আর এই ‘ফর্কটেইল’ অর্থাৎ কালাপিঠ-চেরালেজ যেটা আপনাদের সিলেটের পাহাড়ি জঙ্গলে আছে সেটা কিন্তু শুধুমাত্র পাহাড়ি এলাকা ছাড়া আর কোথাও নেই। মানে নেপাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশে এর বিস্তৃতি। বহু পাখি আপনি বাংলাদেশেও দেখতে পাবেন এবং আমেরিকা গেলেও দেখাতে পাবেন। কিংবা ওই একটি প্রজাতি আফ্রিকাতেও দেখতে পাবেন। এমনিই হয়; পাখিরা বিস্তৃত এলাকা নিয়ে থাকে। কাক, চড়ুই, শালিক, বক, হাঁস প্রভৃতি পাখি বিশাল এলাকা নিয়ে বসবাস করে। কিন্তু কালাপিঠ-চেরালেজ পাখিগুলো খুব ছোট্ট এলাকা নিয়ে বসবাস করে; এর বাইরে তাকে আর কোথাও দেখাতে পাবেন না। এই পাহাড়ি অঞ্চলের বাইরে পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
পাখিটি পায়ে ‘রিং পড়ানো’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এরা পাহাড়ি ঝরনায় যেখানে সারাক্ষণ পানি বয়ে যাচ্ছে যেখানে পানিতে যে পোকা হয় সে পোকাগুলোই এই পাখিটি তুলে তুলে খায়। মানে সে এই পোকা ছাড়া আর কোনো পোকাই খায় না। এটাই তার জীবন। এখানেই সে আবদ্ধ। এবং এখানেই সে বাসা করে। আমি অনেক কষ্ট করেছি এর একটি বাসার দেখার জন্য। অনেক দিন ঝরনার পথে পথে খুঁজে অবশেষে তাকে পেয়েছি। কাপ্তাইয়ের অনেকগুলো ছোট ছোট পাহাড়ি ঝরনা। ধরেন ১০ ফুট নিচে পানি পড়ছে। এই ঝরনার ঠিক পেছনে; একটা পাথরের মধ্যে গর্ত করে সে বাসা করেছিল। এই একটি মাত্র বাসা দেখতে পেয়েছিলাম। ছানাও দেখি। পাখিটাকে ধরে আমি তার পায়ে ‘রিং’ পড়িয়েছিলাম। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পক্ষ থেকে গবেষণার জন্য বিশেষ বিশেষ পাখিদের পায়ে বিশেষ ধরনের ক্ষুদ্রকার রিং পড়ানো হয়। অর্থাৎ সে কত বছর বাঁচে, এরা কোথায় কোথায় যায় ইত্যাদি অনেক তথ্য সংগ্রহের জন্য রিং পড়ানো হয়। পাঁচ বছর আগে তাকে রিং পড়িয়েছি; এখন যদি আবার সেই রিং পড়ানো পাখিটিকে পেয়ে যাই তাহলে আমাদের গবেষণার জন্য এটা দারুণ একটি ব্যাপার হবে। এ জন্যই এটা খুবই স্পেশাল পাখি।
এটি অত্যন্ত নিরীহ-পাখি। এর দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৯ গ্রাম। এরা কিছুটা অন্ধকারের মধ্যেই থাকে। সুন্দর স্বরে মাঝেমধ্যে ডাকে। ওই পাহাড়ি ঝরনা থেকে সে কোনো দিনও বাইরে আসবে না। কিন্তু লম্বা লেজের বেশ বড় পাখি সে। অনেকখানি বড় পাখি। আমাদের দোয়েল সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে। এরা একই পরিবারের পাখি কিন্তু। পাখিটি দোয়েলের ঘনিষ্ট আত্মীয়।
বাংলাদেশে খুবই কম লোকই এই পাখিটিকে দেখেছেন। কারণ আপনি যতক্ষণ না পাহাড়ি ঝরনার দুর্গম অংশের ভেতরে প্রবেশ করছেন ততক্ষণ এই কালাপিঠ-চেরালেজ পাখিটাকে দেখার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আবারও ঝরনাও অন্ধকারে ঢাকা থাকতে হবে। অনেক ঝরনা আছে গাছপালা কম, আলো ছড়িয়ে আসে চারদিকে এমন ঝরনায় পাবেন না। এটা হতে হবে একদই গাছে ঢাকা অন্ধকারময় পাহাড়ি ঝরনা। পানি আবার কম; খুব বেশি পানি নয়। ওই সব ঝরনার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই দেখতে পাবেন এই পাখিটিকে বলে জানান প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০২০
বিবিবি/এএটি