মৌলভীবাজার: শীতের আগমনী বার্তা হিসেবে শরতের সন্ধ্যায় পাহাড়ি এলাকার চারপাশ ঠাণ্ডা হতে থাকে। পথে প্রান্তরে দিনের উত্তাপটুকু গায়ে মাখার পর্ব শুরু হয়।
তবে কোলাহলের কারণে সেসব দৃশ্য এখন অতীত। শহরতলীর নির্জনতাও মুছে গেছে সেই কবে। বনের নির্জনতায় বেঁচে থাকা পাখির নাম ল্যাঞ্জা রাতচরা, তার অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ল্যাঞ্জা রাতচরা নিশাচর পাখি। বাংলাদেশে অন্য রাতচরা প্রজাতিগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি আছে। পৃথিবীতে ৯৭টি প্রজাতি এবং আমাদের দেশে ৬টি প্রজাতির রাতচরা পাখির বিচরণ। এর ইংরেজি নাম Large-tailed Nightjar. তবে বর্তমানে আমাদের দেশে এদের অবস্থা খুব খারাপ। পাহাড়ি এলাকা, নির্জন বাঁশঝাড়, গ্রামের কবরস্থান প্রভৃতি এলাকায় সন্ধ্যায় নামলেই এখন আর ওদের ডাক শোনা যায় না। ’
এর বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাতচরা পাখিদের সবার একটি অদ্ভুত অভ্যাস হলো— এরা রাতে উড়ন্ত পোকা ধরে ধরে খায় এবং দিনে মাটিতে থাকে। গাছের ডালে না, মাটিতে ঘুমায়, আর মাটিতেই ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোটায়। রাতে সে উড়ে উড়ে পোকা ধরে এবং গাছের ডালে বসে। নিজের খাওয়ার জন্য রাতে ৪/৫টি উড়ন্ত পোকা ধরা তো সহজ কথা নয়। আর যদি ছানা হয়, তাহলে তাকে আরও বেশি পোকা ধরতে হয়। ফলে সে সারারাত জেগে থাকে এবং দিনে তাকে ভালো ভাবে ঘুমাতে হয়। ’
গায়ের রং এবং গন্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওর গায়ের রঙ ঝরাপাতার মতো। ঝরাপাতা পড়ে থাকলে যে রকম দেখায় সেরকম। ওর শরীরে কোনো গন্ধ নেই। এই পাখির ডিমে বা বাচ্চার শরীরেও কোনো গন্ধ থাকে না। পাখির তুলনায় তার চোখ অনেক বড়। চোখ বন্ধ করে দিনে সে ঘুমিয়ে থাকে। ওর পা এতো ছোট যে, ও ঠিকমতো মাটিতে বসতে পারে না। ’
স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকবার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ অন্য স্থানে এই পাখি দেখেছি। কিন্তু গত ১০/১৫ বছরে এদের সংখ্যা মারাত্মক ভাবে কমে গেছে। আগে সন্ধ্যার দিকে লাউয়াছড়া যাবার সময় এখন যেখানে গ্র্যান্ড সুলতান নামে রিসোর্ট হয়েছে, এর পাশের মোড়েই দেখতে পেতাম। সন্ধ্যার দিকে রাস্তায় এসে ওরা বসে থাকতো। এছাড়া, লাউয়াছড়ার ভেতরে প্রবেশ করলেই ‘ট্রাক ট্রাক ট্রাক’ স্বরে ডাকতো। ’
‘গ্রামেগঞ্জে আগে সব সময় বাঁশবন থেকে এই পাখির ডাক শোনা যেতো। এখন শোনা যায় না। এর একটি কারণ— আমরা সব পোকা মেরে ফেলেছি। ফলে পাখিটি প্রায় বিরল হয়ে গেলো। আগামী ১০ বছরের মধ্যে হয়তো সারাদেশে একটিও দেখতে পাবো না। ’
অবস্থান সম্পর্কে এ গবেষক বলেন, ‘সংখ্যা অনেক কমে গেলেও সে হয়তো টিকে থাকবে আরও কিছুদিন। কারণ সে নিশাচর পাখি বলে মানুষের হাতে সরাসরি মারা পড়ছে না। তবে মানুষের কারণে ওর থাকার জায়গা এবং খাদ্য কমে যাচ্ছে। ওদের বিলুপ্তি ধীরে হবে বলে আমরা আশা করি। তাই এ প্রজাতিটি বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় এখনো ওঠেনি। তবে ওরা এখন বিরল প্রজাতির নিশাচর পাখি। ’
প্রখ্যাত এ পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঝরাপাতা রঙের ডিম পাড়ে ওরা। বাচ্চাগুলোও হয় ওই রঙের। ওরা যদি মাটিতে বসে থাকে তবে আপনি সহজে ওদের দেখতে পাবেন না। এভাবেই সে টিকে ছিল এত কাল। সুন্দর এ পাখিটি বিশেষ করে সন্ধ্যার পর যখন উড়ে উড়ে পোকা ধরে, তখন ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় যেন একটি ঘুড়ি বাতাসে উড়ছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
বিবিবি/এফএম