মৌলভীবাজার: পৃথিবীর সেরা জীব হিসেবে মানুষ আজ হারাতে বসেছে তার যোগ্যতা! নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিটুকু ক্রমশই লোভ আর লালসায় পরিণত হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে মানুষের সীমাহীন লোভের দৃষ্টান্ত তার চারপাশের জগতে আশ্চর্যের সঙ্গে ধরা পড়ছে।
মানুষের আরো, আরো চাই! চিরসবুজ অরণ্যভূমিকে উজার করে খেয়েও ক্ষান্ত হয়নি প্রকৃতিবিরোধী কিছু মানুষ। যে খাবারটি কয়েকটি বন্যপ্রাণী প্রজাতির অন্যতম পছন্দের খাবার। বলা চলে, বর্ষা মৌসুমে এই খাবারটি খেয়েই তারা প্রকৃতিতে টিকে আছে। এবার এসে মুনাফালোভী মানুষ ভাগ বসিয়েছে বন্যপ্রাণীর একমাত্র খাবারেও। এ খাবারটির নাম চাপালিশ। কোনো কোনো অঞ্চলে চাম কাঁঠাল বলে। চাম কাঁঠাল হচ্ছে আকারে কাঁঠালের চেয়ে বেশ ছোট, হাতের মুঠোয় নেয়া যায়। টক-মিষ্টি স্বাদের ফল।
তবে কি মানুষের খাবারের অভাবে পড়েছে বাজারে? না, তাও পড়েনি। মানবোপযোগী প্রচুর খাবার রয়েছে আমাদের দৈনিক খাদ্যের তালিকায়। মানসিকভাবে অসুস্থ কিছু মানুষ তাদের নিজের স্বার্থের জন্য টার্গেট করেছে এই বন্যপ্রাণীদের প্রিয় খাবারটিকে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরের কয়েকটি স্থানে বন্যপ্রাণীদের খাবার চাপালিশকে জনসম্মুখে বিক্রি হতে দেখা গেলো। মানুষের ক্রমবর্ধমান লোভ-লালসার টার্গেটে পরিণত এই পাহাড়ি ফলটি হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই বিপন্ন হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে প্লাম্পলরিস ই.ভি, বাংলাদেশ এর প্রকল্প পরিচালক এবং বন্যপ্রাণী গবেষক হাসান আল রাজী বাংলানিউজকে বলেন, ‘শুধু শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার বা সিলেটেই নয়; আমি ঢাকাতে লক্ষ্য করেছি এই চাপালিশ ফল সংগ্রহ করে বিক্রি এখন বাণিজ্যিক একটা বিষয় হয়ে গেছে। আমার বন্ধুতালিকার উচ্চ শিক্ষিত কর্মকর্তা কেউ কেউ তারাও চাম কাঁঠাল কিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছে: আজ চাম কাঁঠাল কিনলাম। ’
‘যেহেতু আমি বানরগোত্রীয় প্রাণী নিয়ে কাজ করি তাই এই ব্যাপারটি আমাকে দারুণভাবে মর্মাহত করেছে। বানরগোত্রীয় প্রাণীদের একটা বড় খাবারের অংশই হলো এই চাম কাঁঠাল। শুধু বানর না, এই চাপালিশ গন্ধগোকুলও খায়। অনেক প্রাণীরা খায়। পাখিরা খায়। গাছ থেকে যখন পড়ে ফেটে গেল তখন নিচে যেসব প্রাণী থাকে এবং যারা গাছে উঠতে পারে না সেসব বন্যপ্রাণী খায়। এই বন্যপ্রাণীর খাবারটি যদি এভাবে বন থেকে পাহাড় থেকে বাণিজ্যিকভাবে সংগ্রহ করে তাহলে এটা অবশ্যই একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট (বিরূপ প্রভাব) ফেলবে। বন্যপ্রাণীর খাবারের সংকট তৈরি হবে। তাদের পুষ্টির সমস্যা হবে। অবশ্যই বড় ধরনের ইমপ্যাক্ট ফেলবে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সচেতনার বিষয়ে এই বন্যপ্রাণী গবেষক বলেন, ‘এই চাম কাঁঠাল যেহেতু এতোদূর পর্যন্ত চলে আসতেছে তাহলে আমার মনে হয় যে অনেক বেশি বেশি পরিমাণে সেগুলো পাড়ছে। সে ক্ষেত্রে বনবিভাগকে আরো একটু সতর্ক হওয়া দরকার। বনে কারা যাচ্ছে, কী করতে যাচ্ছে – এগুলো বেশি করে দেখা দরকার। হয়তো বন্যপ্রাণীর এই খাবার সংগ্রহের বিষয়টি এখনো বন বিভাগের চোখে পড়েনি। ’
মানুষের খাবারে পরিণত হওয়া বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে বন্যপ্রাণীর খাবার উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। এ বছর ছোট পরিসরে চামকাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে, পরের বছর আরেকটু বড় পরিসরে এই ব্যবসা প্রসার পাবে। তৃতীয় বছর হয়তো দেখা যাবে যে, আরো ব্যাপাক পরিসরে এই চামকাঁঠাল বিক্রির মার্কেট তৈরি হয়ে গেলো। এরপর দেখা যাবে যে, বানরের খাবার হিসেবে চাপালিশ আর বনে অবশিষ্ট নেই। এগুলো মানুষের খাবার হয়ে গেছে। ’
তিনি আরো বলেন, আমার মতে, লাউয়াছড়া-সাতছড়ির মতো জায়গায় একটাই বন্যগাছ দেখি আমাদের নিজেদের পিসিস (প্রজাতি) এই বনের সেটা হলো- চাপালিশ। যেটা ছায়া দিচ্ছে, বড় একটা আচ্ছাদন দিচ্ছে আবার খাবারও দিচ্ছে। যেটা যদি এভাবে কিছু মানুষের দ্বারা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে এটা আমাদের জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকির।
আরেকটি বড় ব্যাপার আছে, প্রতি বছর চাপালিশের যে বীজগুলো পড়ছে সেখান থেকে দু-একটা চারা অন্তত নতুন করে সারভাইব (টিকে থাকা) করছে। সেটা যদি এভাবে নিয়ে যায় তাহলে কিন্তু বন্যপ্রাণীদের খাবার চাপালিশ গাছ আর প্রকৃতিকভাবে নতুন করে জন্মাবে না বলে জানান বন্যপ্রাণী গবেষক হাসান আল রাজী।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০২২
বিবিবি/এএটি