ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

‘মোগো কোনো মে দিবস নাই’

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০১ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৩
‘মোগো কোনো মে দিবস নাই’

পাথরঘাটা (বরগুনা): আবদুর জব্বার, বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। এই বয়সেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর সমুদ্রে জীবন বাজি রেখে মাছ শিকার করছেন, শুধু মাছ শিকারই নয়, সাগর থেকে মাছ শিকার করে এসে আবার সাগরে যাওয়ার জন্য জাল বোনার কাজও করছেন।

 

অপর জেলে মো. ফারুক হোসেন, বয়স ৫০ বছর। আবদুর জব্বারের মতো একই রকম কাজ করছেন তিনিও।

উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটা। ছগির হোসেন, আলতাফ মিয়া, হায়দার আলী, এমাদুলের মতো এ উপজেলায় অধিকাংশ মানুষই মৎস্য কাজের ওপর নির্ভরশীল। পরিবারের মায়া ছেড়ে নিরাকার অথৈ সাগরে জীবন বাজি রেখে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করেন তারা। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩.৫০ শতাংশ। মৎস্য শ্রমিকদের জিডিপিতে এতো অবদান থাকলেও আজও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। এমনকি শ্রমিক হিসেবে মে দিবসেও তাদের কোনো কদর নেই।

জীবন বাজি রেখে যারা প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধ করে মাছ শিকার করছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এক রকম আক্ষেপ করেই বললেন মে দিবস আবার কি?’ আমাগো মে দিবসও নেই, কোনো দিবস নেই।  

কথা হয় আবদুর জব্বারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৪২ বছর ধরে সাগরে মাছ ধরছি। জীবন বাজি রেখে পরিবারের মায়া ছেড়ে সাগরে যাই। কতবার যে বন্যায় ডুইবা গ্যাছি তার হিসাব নাই, জীবন-মরণ কয়েকবার দেইখ্যা আইছি। এখন বুড়া হইয়া গ্যাছি, এখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়া সাগরে মাছ ধরতে যাই।

সোমবার (১ মে) শ্রমিকদের জন্য প্রতি বছর এ দিন 'মে' দিবস পালিত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে জেলে ছগির হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিবস দিয়া কি অইবে...। মোগো কাজই বড়। কাজ না করলে খামু কি? ঝুঁকি নিয়া সাগরে মাছ শিকার করি, আবার কুলে আইসা জাল বুনি। সারাদিন জাল বুনে ৪০০ থেকে ৪৩০ টাকা পাই। তাও আবার সব সময় পাই না।

অপর জেলে মো. ফারুক বলেন, দাদন নিয়া সাগরে যাই মাছ ধরতে, মাছ পাইলে ১৬ ভাগের ৮ ভাগ মালিকের। আর ৮ ভাগ থেকে ১৮ জন জেলের মাঝে উপার্জনের ওপর বন্টন হয়। বাজার সদায়ের খরচ শেষে লাভ থাকলে ভাগে টাকা পাই, লোকসান থাকলে পাই না। মোরা যে এতো কষ্ট কইরা মাছ শিকার করি আজ পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবে মোগো কেউ দ্যাহে না।

পাথরঘাটা উপজেলায় অধিকাংশ মানুষ জেলে পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু এসব জেলেদের শ্রমিক হিসেবে কেউ ডাকে না, তাদের শ্রমিক হিসেবে মূল্যায়নও করে না।  

এ ব্যাপারে জাতীয় শ্রমিক লীগের পাথরঘাটা উপজেলা শাখার সভাপতি আব্দুল আউয়াল বলেন, দলীয়ভাবেও জেলে শ্রমিকদের দলে বিবেচনা করা হয় না। আমি বিগত কয়েক বছর ধরে মৎস্য শ্রমিকদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেছি।  

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষক এস এম জাকির হোসেন বলেন, উপকূলের মৎস্য শ্রমিক (জেলে) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করছেন। কখনো দস্যুদের কবলে আবার কখনো দুর্যোগেও প্রাণ হারাতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে মৎস্য শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি এবং সরকারি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পেতে সর্বোচ্চ মহলে লিয়াজোঁ করে আসছি।

তিনি আরও বলেন, এখানে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো জেলেদের কোনো কর্ম ঘণ্টা নেই। সাগরে থাকাকালীন চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে তারপরও তারা শ্রমিক নয়।

উপকূলের জেলেদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, মৎস্য সেক্টরের সঙ্গে জড়িত শুধু মাছ ধরা শ্রমিকরাই নয়, জাল বুনা, ট্রলার মেরামত করা, বরফ তৈরি করার কাজে নিয়োজিত উপকূলের হাজারো শ্রমিক। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান জেলেদের থাকলেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তাদের নিয়ে গবেষণা তো দূরের কথা তারা যে শ্রমিক এটাও সরকারের ধারণাই নেই। অথচ প্রতিনিয়তই এসব শ্রমিকরা সাগরে ট্রলার ডুবে, দস্যুদের গুলিতে মারা যায়।

তিনি আরও বলেন, নগর মহানগরে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিকদের অধিকার, ন্যায্যতা নিয়ে যতটা আলোচিত হয়েছে বা তাদের ন্যায্যতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে উপকূলের জেলেদের কাছে কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছে এ মুহূর্তে সেটি মুখ্য বিষয় নয়। এ অঞ্চলের জেলে শ্রমিকরা আদৌ শ্রমিক কিনা, শ্রমিক হলে তাদের প্রাপ্যতার বিষয় কতটুকু জানলো তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো জেলেদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এখনই সময়। একটি পরিসংখ্যানে সরকারি তথ্যানুযায়ী গত ৭ বছরে বৈরী আবহাওয়ায় বরিশাল বিভাগে সমুদ্রগামী ২৫৯ জেলের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসেবে এর চেয়ে অনেক বেশি।

শ্রম অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের ডিডি ওসমান গণি বলেন, সরকারি গেজেট অনুযায়ী জেলেরাও শ্রমিক। এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের এসব মৎস্য শ্রমিকরা এ বিষয় জানেন বিধায়ই তারা ‘শ্রমিক না’ হিসেবে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারাও (জেলে) মৎস্য শ্রমিক।

তিনি আরও বলেন, মৎস্য শ্রমিকদের (জেলে) অধিকার নিশ্চিতে বা শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে তাদের সচেতন হতে হবে এবং মৎস্য শ্রমিক সংগঠন তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, মে ০১, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।