কলকাতা: গোটা বিশ্বে ভারতীয় খাবার বলে পরিচিত ‘ইডলি’ আদৌ ভারতীয় নয়। সিঙ্গারা বা সমোচাকে আদ্যন্ত ভারতের আবিষ্কার বলে মনে করা হলেও সেগুলো ভারতীয় খাবার নয়।
এমনকি দক্ষিণ ভারত যাকে নিজেদের করে নিয়েছে, সেই কফিও একেবারেই ভারতীয় খাবার নয়। যা ছাড়া ভাত বা রুটি খাওয়ার কথা কল্পনাই করা যায় না, সেই মরিচ বা লঙ্কার ব্যবহার ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে পর্তুগিজদের হাত ধরে।
সকলের প্রিয় আলুও আসলে বিদেশি।
কোটি কোটি ভারতীয়ের নিত্যদিনের খাবার ‘বড়াপাও’ এসেছে ভিনদেশি হেঁশেল থেকে। খাবারগুলো এতোটাই জনপ্রিয় যে, সেগুলো ভিনদেশ থেকে আসা বলে মনেই হয় না।
ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন, এ সমস্ত খাবারই উপমহাদেশে আমদানি বিভিন্ন দেশের পর্যটক বা বাণিজ্য করতে আসা নাবিকদের হাত ধরে।
দক্ষিণ ভারতে চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি ইডলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। অনেকেরই ভাবতে কষ্ট হবে যে, ইডলি আদতে ভারতের খাবারই নয়। ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন, ইডলি ভারতে এসেছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ইডলি এসেছে আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে।
তবে যে ঐতিহাসিকরা দাবি করছেন, আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ইডলি ভারতে এসেছে, তাদের মতে, আদতে ইডলি ছিল একটি মাংস মিশ্রিত খাবার। যেটি ভারতে এসে নিরামিষ খাবারে পরিণত হয়।
আরবে চালের সঙ্গে মেশানো হতো মাংস। এটিই ছিল ইডলির প্রাথমিক পর্যায়।
বড়াপাও ভারতের বড় অংশের মানুষের প্রতিদিনের প্রাতরাশের অঙ্গ। একটি ব্রেডকে কেটে তার মাঝে দেওয়া হয় একটি বড়া। অনেক সময় পাও বা ব্রেডের ওপরেও বড়াটিকে সাজিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে আচার ও মরিচ।
চটপট স্বাদের খাবারটি মুম্বাই ও গোয়ার প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায়। কলকাতায়ও বড়াপাও বেশ জনপ্রিয়।
ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন, বড়াপাও এসেছে পর্তুগিজদের কাছ থেকে। ‘পাও’ শব্দটিও পর্তুগিজ, যেটি পরবর্তী সময়ে হিন্দি শব্দ ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে।
বলা হচ্ছে, পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা-গামার হাত ধরেই কেরালার কালিকট বন্দরে পা রাখে ‘পাও’। তার ধারাবাহিকতায় আজকের বড়াপাও এর জন্ম।
দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠা কফি’র উৎস হিসেবে ঐতিহাসিকদের কলমে উঠে আসছে ইথিওপিয়ার নাম। তবে ভারতে কফি এসেছে ইয়েমেন থেকে। বাবা বুদান নামের একজন ইয়েমেনি ভারতে কফি নিয়ে এসে কর্ণাটকের পাহাড়ে চাষ শুরু করেন।
ইউরোপে কফিকে জনপ্রিয় করেন মার্কো দা ভিয়ানো। সেখানে এসে কফির সঙ্গে মেশে দুধ আর চিনি। কফির জগতে বিখ্যাত ‘ক্যাপুচিনো’ নামটি ভিয়ানোর দেওয়া। পরবর্তী সময়ে ইথিওপিয়া থেকে কফি আরবে প্রবেশ ও আরবের মানুষের মন জয় করে নেয়।
সিঙ্গারা ও সমোচার ইতিহাসে ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, পার্সিয়ান শব্দ ‘স্যানবোস্যাগ’ থেকে সমোচা শব্দটি এসেছে। আর সম্ভবত শিঙের আকার থাকায় তার নাম হয়েছে সিঙ্গারা। আমির খসরু প্রথম ‘সমোচা’ নামের খাবারের উল্লেখ করেন।
সে সময় তিনি ছিলেন দিল্লির সুলতানের দরবারে। তার বর্ণনায় সমোচার ভেতরে থাকতো মাংসের পুর। বর্তমানে আলুসহ নানা ধরনের পুর দেওয়া হয় সমোচায়।
পশ্চিমবঙ্গে যাকে আলু বলা হয়, তাকেই মুম্বাইয়ে বলা হয় বাটাটা। ঐতিহাসিকরা বলছেন, বাটাটা আমদানি করেন পর্তুগিজরা। পেরু থেকে স্পেনের মানুষদের হাত ধরে প্রথমে এটি ছড়িয়েছিল গোটা ইউরোপে। তারপর ব্রিটিশদের হাত ধরে বাংলায় প্রবেশ করে আলু। এরপর এমনভাবে ভারতীয় খাবারে মিশে যায় যে, বিশ্বাস করতেই অসুবিধা হয়, আলু ভারতের খাবার নয়।
একই ধরনের ইতিহাস আছে মরিচ বা লঙ্কারও। এটিও পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল। তবে এর আবিষ্কারক পর্তুগিজরা নন, মেক্সিকোর নাবিকরা। তারাই প্রথম এটিকে বিশ্বের সামনে নিয়ে আসেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যায় রসনার স্বাদ আর গন্ধ। পর্তুগিজরা যখন সঙ্গে নিয়ে আসেন, তখন থেকেই মরিচের ব্যবহার শুরু হয় ভারতে।
এ ধরনের আরও কিছু খাবার আছে, যেগুলো ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয়, কিন্তু জন্ম বিদেশে। খাবারগুলোর স্বাদ এখানকার মানুষদের এতোই প্রিয় যে, তারা এসব বিদেশি খাবারকে নিজেদের খাদ্যাভ্যাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৪ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০২৩
ভিএস/এসআই