ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

রেমা-কালেঙ্গার বন-পাহাড়ে-৯

ভিলেজারদের পাহারায় টিকে রয়েছে বন

শুভ্রনীল সাগর, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন ও জিয়া উদ্দিন দুলাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৫
ভিলেজারদের পাহারায় টিকে রয়েছে বন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রেমা-কালেঙ্গা থেকে ফিরে: মূল গেট থেকে হাতের বামে লালমাটির পথ। বনের পাশ দিয়ে এ পথ গেছে সোজা শ্রীমঙ্গল।

এদিক দিয়ে সেগুনবনে ঢোকাটা সহজ। বনের ভিতর দিয়ে মক্কা ঘুরে বিলাত না এসে, সরাসরি বনের পাশ দিয়ে ঢোকা যায়।

এতসব তো আর আমাদের জানার কথা নয়। ইকো গাইড তাজুল ইসলাম স্বপনের (৩৫) টর্চের আলোয় পথ চলতে চলতে জানা। তখন মধ্যরাত। এমনিতে বনাঞ্চলে ঝপ করে সন্ধ্যা নামে। এসব জায়গায় সন্ধ্যা ৭টা মানে কার্যত মধ্যরাত। বাংলোর কেয়ারটেকারের বাড়িতে রাতের আহার সেরে বনে ঢুকতে ঢুকতে রাত তখন সাড়ে ১০। বলা যায়, গভীর রাত!

বনের প্রায় ১১১ একর জুড়ে সেগুনগাছ। দাফতরিক ভাষায় যাকে বলে পরিকল্পিত বন। অন্য গাছগুলো যেমন-তেমন, পাচারকারীদের কাছে চাপালিশ, কড়ই ও আকাশমণি গাছের চাহিদাই বেশি। আর দামের দিক দিয়ে সেগুন তো শীর্ষে। এখানে পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা দামের গাছও রয়েছে।

বলতে গেলে প্রায় সারাটা দিন বৃষ্টি হয়েছে। পথঘাট একেবারে জলকাদাময়। আধো আলো আধো অন্ধকারে টাহর করে যেখানে পা ফেলছি, সেখানেই প্যাচ প্যাচ করে উঠছে! এর মধ্যে স্বপন ভাই আবার বলে দিলেন, পা ফেলতে হবে দ্রুত। নইলে শরীরে জোঁক উঠে আসবে।

‘সেগুনগাছের দিকেই গাছ পাচারকারীদের নজর বেশি। দামি দামি সব গাছ। এজন্য এখানে টাইট পাহারা দিতে হয়। গোটা শালবন তিনটি টংয়ে ভাগ করে পাহারা দেওয়া হয়। একেকটি টংয়ে একজন ফরেস্ট গার্ডের সঙ্গে দু’জন ভিলেজার পাহারা দেন। ’

গল্পে গল্পে চার মনুষ্যসন্তানের পা চলছে। কখনও উঁচু, কখনওবা ঢালু পথ। পায়ের জুতো যেন ভিজে রসমালাই। ঘন বন মানে হরেক লতাপাতার ঝোপ। দু’হাতে সরিয়ে সরিয়ে সামনে এগুলে কানে-মুখে সুড়সুড়ি লাগে। কখনও ভেজা লতা শরীরে লেগে মনে হবে ঘাড়-গলা বেয়ে সাপ উঠছে!

এদিকে, হাঁটতে হাঁটতে পা আর চলছে না। ভাই আর কতো! সত্যিই কি রাতে পাহারা দেয় নাকি এমনি ওই একটু ঘুরে-টুরে চলে যায়?

‘চলেন, নিজের চোখেই দেখবেন’।

স্বপন ভাই মজা করে না রেগে উত্তর দিলেন বোঝা গেল না! রাগতে পারেন কারণ, তিনি নিজে একজন ‘ভিলেজার’। ভিলেজারের সোজা বাংলা- গ্রামবাসী। এখানেও তাই। তবে তারা সংরক্ষিত অঞ্চলের বাসিন্দা। এটি একটি দাফতরিক শব্দ। এখানে ৯৭ পরিবার ভিলেজার রয়েছে। প্রত্যেক পরিবার দুই একর করে সংরক্ষিত অঞ্চলের জমি পায়। বিনিময়ে বন সংরক্ষণে বন বিভাগকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবেন তারা।

‘ওই কে!’

জমাট আঁধার চিরে দূর থেকে হাঁক আসে।

‘আমি স্বপন। কালেঙ্গা সদর থেকে’।

রেমা-কালেঙ্গার মূল গেট ও তার সামনের ছোট বাজার হচ্ছে কালেঙ্গা সদর। গ্রামের নামও কালেঙ্গা। পড়েছে চুনারুঘাট উপজেলার রানিগঞ্জ ইউনিয়নে, জেলা হবিগঞ্জ।

হাঁকদাতার কাছে পৌঁছাতেই ‘টং’ ব্যাপারটি বোধগম্য হলো। টং এসেছে টংঘর থেকে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় যেভাবে নিচে খুঁটি পুঁতে বেশ উঁচু করে ঘর বাঁধে, টংঘর ঠিক সেরকম। রাতে সাপসহ অন্য বন্যপ্রাণিদের হাত থেকে বাঁচতে এ উপায়। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখা দিলেন দুই ভিলেজার আর একজন ফরেস্ট গার্ড।

নানা বিষয়ে এই কথা সেই কথা। এক ফাঁকে দুই ভিলেজারের কাছে প্রশ্ন, বন বিভাগ থেকে জমি পেয়েছেন বলে বাধ্যতামূলক রাতের ডিউটি করছেন, নাকি..

পুরোটা শেষ না হতেই উত্তর দেওয়া শুরু করলেন মো. মঈন উদ্দিন (৪৯), এসব গাছ আমাদের বাপ-দাদাদের লাগানো। আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। আগে তারা পাহারা দিতেন। এখন তারা বুড়ো হয়ে গেছেন বলে আমরা দিই। এরপর আমাদের ছেলেরা দেবে। এই বন আমাদের বাস্তুভিটার মতো। রোজ রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা অব্দি আমরা ভিটে-মাটি পাহারা দেওয়ার মতো করে আগলে রাখি।

আর জমি নিয়ে কী এমন হয়! বনের অধিকাংশ জমিতেই আবাদ করা যায় না। ভাত-কাপড়ের জন্য আমাদের অন্য কাজ করতে হয়। বনকে ভালোবাসি বলেই পাহারা দিই, পাশ থেকে বললেন মো. আবদুল হাই (৪৮)।

ভিলেজার প্রসঙ্গে ফরেস্ট গার্ড আরজুর রহমানের (৪৬) ভাষ্য, তারা রয়েছেন বলেই বন এখনও টিকে রয়েছে। আমরা তো মোটে ৩৩ জন। এতবড় বন এ কজনে পাহারা দেওয়া সম্ভব না। ভিলেজাররা না থাকলে দু’দিন লাগবে বন উজাড় করতে!

এতবড় বনে গাছ কাটা হলে কীভাবে বোঝেন? ‘গাছ কাটলে বা পড়লে অনেক দূর থেকেও স্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। তখন শব্দ লক্ষ্য করে আমরা এগোই। পাশাপাশি বিট অফিসারকে ফোন করে জানিয়ে দিই। তারাও একটি দল নিয়ে বের হন। ’
                             
গাছ কাটার হার নিয়ে অতীত-বর্তমানের তুলনা জানতে চাইলে বলেন, আগের তুলনায় গাছ কাটা এখন অনেক কমে গেছে। নেই বললেই চলে।

‘আগে বেশি কাটা পড়ত কারণ, তখন এত সিস্টেমেটিকভাবে পাহারা দেওয়া হতো না। ধরা পড়লে শাস্তিও বলার মতো ছিল না। বর্তমান ফরেস্ট রেঞ্জার খুব কড়া। ধরা পড়লে সোজা জেল। গুলিতে দু-একজন পাচারকারী মারাও পড়েছে। এই ভয়েও অনেকে আসে না’।

আলাপ-আলোচনা তখন সামগ্রিক হয়ে গেছে। পাচারকারীরা আসলে কারা, আসেই বা কোথা থেকে?

এবার মুখ খুললেন স্বপন ভাই, বেশিরভাগ পাচারকারী পার্শবর্তী রানিগাঁও, হিমালিয়া, বরদুশা, লালমুখ, বাশুল্লা, কবলাশপুর থেকে আসে। এদের পিছনে বড় বড় নেতারা থাকেন। এখান থেকে গাছ পাচার হয়ে ত্রিপুরাও যায়। সেখান থেকে ফার্নিচারের কাঠ হয়ে আবার এখানকার বাজারে চলে আসে।

ফেরার পথে যেতে যেতে স্বপন ভাইয়ের জোর দাবি, ‘ভাই, ভিলেজারদের কাছে বনই সব। সে আপনি যেই হোন না কেন, বনের জন্য যে ভালো, আমাদের কাছে সেই ভালো। ’

বোঝা গেল, আমাদের ইকো গাইড তাজুল ইসলাম স্বপন তার দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এর মধ্যে ভিলেজার বনে গেছেন!

বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৫
এসএস   

** নিরাপত্তাকর্মীরাই নিরাপত্তাহীনতায়
** পাহাড়ের ভাঁজে অরণ্যের দিনরাত্রি
** ৩৩ জনের কাঁধে দেশের ২য় বৃহত্তম বন
** সৌরবিদ্যুতে আলোকিত বনাঞ্চল
** যে রাস্তায় অটোরিকশা হয়ে যায় সিন্দ‍াবাদের জাহাজ!
** পাখির ডাকে রাত, পাখির ডাকে দিন
** বন্যপ্রাণীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়াশ্রম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।