ঝালকাঠি থেকে ফিরে: ১৫টি পরিবার। লোক সংখ্যা শ’ খানেক হবে।
এদিকে থাকার ঘরগুলো মাচার ওপর ত্রিপল দিয়ে কোনো রকমে ঠেকানো। ঝাড়ফুঁক-তাবিজেই মুক্তি-আয়-উন্নতির কুসংস্কার জীবন। শিক্ষার আলো বঞ্চিত শিশুরা। সচেতনতার নেই লেশমাত্র ছাপ। সব মিলিয়ে জীবন তাদের মানবেতর, সমাজে এ জীবনের অবস্থান কোথায়, কোন পর্যায়ে- এ প্রশ্নই করলেন তারা। যাযাবর জীবনে কী মূল্য আছে! জানালেন এমনটাই।
বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্র সব পেশার এই মানুষগুলোর উদাহরণ শুধু তারাই। বেদে হিসেবে তাদের পরিচয়। বৈচিত্র্যঘেরা জীবনাচারের অধিকারী তারা। তন্ত্র-মন্ত্র, যাদু-টোনা ও বশিকরণ বিদ্যায় যাদের আজন্ম ধারণ করা বিশ্বাস, এ থেকে বেরিয়ে সাধারণ জীবন না তারা নিজে খুঁজে পান, না কেউ খুঁজে দেন।
১৫ পরিবারে ২ বেড়ার টয়লেট, একটি উপমা মাত্র বললেন মো. আজাদ সরদার (৩৫)। তিনি বেদেপল্লীর মূল তত্ত্বাবধায়ক। যাকে বলা হয় সরদার। ঝালকাঠি জেলা শহরের কলেজ মোড় মাঠে তাদের অস্থায়ী বাস। কথা হয় আজাদের সঙ্গে। এখানে আট থেকে নয় মাস হলো এসেছেন। আগে ছিলেন বরিশালের দবদবিয়া সেতু এলাকায়, তার আগে বাকেরগঞ্জ এবং তারও আগে পটুয়াখালী জেলায়। যাযাবর জীবনে নির্দিষ্ট কিছুই নয়, কাজও নেই স্থায়ী। ঠিকানাবিহীন, অজানা, অচেনা ও অপরিচিত স্থানে ঘুরে বেড়ানোই জীবন। চলাফেরা বহর বেঁধে। ভ্রমণশীল, ছন্নছাড়া, ভবঘুরে কিংবা যাযাবরের জীবনধারনে বেঁচে থাকার চেষ্টা মাত্র।
শোনালেন এই বেদেবেশ থেকে বের হতে চাওয়ার গল্প। তবে কে বের করবে তাদের! কেউ তো সহানুভূতির চোখে দেখে না। ফলে উল্টো চড়াও জীবনযাপন করতে হয়। নারীরা (তাদের ভাষায় বাইদ্যানী) রাস্তায় নেমে জোর করে তাবিজ-কবজের নামে টাকা আদায় করেন, পুরুষরা (বাইদ্যা) বিভিন্ন ভেষজ ওষুধি চিকিৎসার ঝাঁপি নিয়ে ঘুরে বেড়ান দিকবেদিক। এছাড়া ঝাড়ফুঁক, চুড়ি, ফিতা, আলতা বিক্রি, সিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা, জন্ডিস ছাড়ানো, সাপ-বানরের খেলা ও জাদু দেখানো, মাছ ধরার মতো কাজ করেন সুযোগে-সুবিধায়।
মোট নয়টি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বেদে সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে- সাপুড়িয়া, বান্দাইরা, চাপাইলা, গাইন, বাজিকর, বেজ, মেলচ্ছ, মাল ও লাউয়ো।
যার মধ্যে সাপুড়ে বা সাপুড়িয়া জনগোষ্ঠীর মূল কাজ সাপ ধরা। মানুষের বিশ্বাসের ওপর ভর করে সাপের বিষ নামানো-খেলা দেখানো, কড়ি চালান দিয়ে বা বীণ বাজিয়ে সাপ আনা, সাপে কাটা মানুষকে তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে সুস্থ করে তোলা ইত্যাদি। প্রাচীনকালে সবগুলো সম্প্রদায়ের দেখা মিললেও এখন সাপুড়িয়া ছাড়া অন্য আটগোষ্ঠীর দেখা খুব একটা মেলে না। তবে ভাসমান কিছু কিছু বেদে সম্প্রদায়ে বিরল গোষ্ঠী রয়েছে।
মো. আজাদ সরদার জানান, সময়ের সঙ্গে পূর্বপুরুষের পেশায় পরির্বতন এসেছে তা যেমন সত্যি ঠিক তেমনি পরির্বতন এসেছে জীবনাচরণেও। যুগ আধুনিক হয়েছে। আমাদের সাপুড়েদের ওপর কমেছে বিশ্বাস। তবে নিজেরা বিশ্বাস হারাইনি। তাই খেয়ে-কাটিয়ে বেঁচে আছি। আর করবোই বা কী! আসেনি শিক্ষা, ভবিষ্যতের কোনো পাথেয়। ফলে এখনও ভবিষ্যৎ ওই ঝাড়ফুঁক এবং সাপ সংশ্লিষ্টই। এমনকি আমাদের সন্তানদেরও তাই হবে।
আজাদ ক্ষোভ নিয়ে বলেন, আমরা সাপ লালন করি। কই সরকার তো আমাদের লালন করে না! দেশের নাগরিক আমরা। হয়েছি ভোটার, রয়েছে আইডি কার্ড। তবু নেই কোনো অধিকার। কেউ তো পাশেই আসে না! সুযোগ দিলে আমরা সমাজের থেকে বাইরে থাকতাম না, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা হতো। আস্তে আস্তে খেয়াল-খুশি মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবনের মোড় পরিবর্তন করে নিতে পারতো। এসব তো স্বপ্ন-বিলাসিতা। সাধারণ কিছুই তো পাই না আমরা।
আজাদের পাঁচ ছেলে, বয়স- ৪, ৫, ৯, ১২ ও ১৬। বেদে জীবনে নেই সচেতনতা তাই একটি মেয়ে সন্তানের আশায় জন্মেছে পাঁচ ছেলে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, থাকারই যেখানে ঠিক নেই, বাঁচারই ঠিক নেই, তো জন্মের কী ঠিক থাকবে! কেউ তো কখনও আমাদের কোনো সঠিক পরামর্শ দিতে এলো না। যেখানেই যাই এমনই জীবন। শুধু ঝালকাঠি কেন সব পল্লীতেই একই পরিস্থিতি আমাদের।
তিনি বলেন, মানবেতর জীবনে বড় একটি সমস্যার নাম অনিরাপদ স্যানিটেশন। ১৫ পরিবারের জন্য মাত্র দু’টি টয়লেট। তাও আবার জোড়া-তালির বেড়ার! এখানে নেই পানির ব্যবস্থা। পাত্রে পানি নিয়ে ঢুকতে হয়। পয়ঃনিষ্কাশন নেই, থাকে জমে!
এই দুই টয়লেট শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনেই ব্যবহার হয় বললেন, বেদে নারীরা। তারা বলেন, আমাদের শারীরিক কোনো সমস্যায় কেউ পাশে নেই। আধুনিক কোনো সেবা পাই না আমরা। নিজেরা নিজেদের চিকিৎসক। নারীদের জন্য অন্তত চিকিৎসা বা তাদের যে কোনো সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মত দেন বেদে নারীরা।
শুধু তাই নয়, ঠিক নেই রান্না-বাড়ার। ঘরের সামনে কোনো রকমে চুলা জ্বালিয়ে চলে রন্ধন কাজ। ঝাপটা বৃষ্টি এলে পানি ঢুকে ঘরে। সৃষ্টি হয় কাঁদার। খুপড়ি ঘরেই স্বামী-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতে হয়। দূর থেকে কেউ বেড়াতে এলে তারও স্থান হয় সেখানে। এর মধ্যেই কাটাতে হয় জীবন- জানালেন বেদে নারীরা।
পল্লীর সহকারী সরদার জালাল বলেন, কুসংস্কারের জীবন আমাদের। বিশ্বাস আছে এখনও জাদুটোনায়, সাপ বিষয়ে। যদি নাই বা থাকে তবে পেটের ভাত জোগাবো কী দিয়ে। মানুষের সোনা-রূপা হারিয়ে গেলে খুঁজে দিই, বাটি চালান, চালপড়া, তাবিজ, ব্যথার মাজন, মালিশ, সাপ ধরে ঢাকায় বিক্রি এসবই এখন আমাদের মুখ্য কাজ।
‘লাগবে নাকি কিছু আপনারও, না লাগলে নাই। এসেছেন যখন বাচ্চাদের জন্য দু’টা ভাত খাওয়ার টাকা দিয়ে যান, দিয়ে যান কিছু...’
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৫
আইএ
** এই শিশুদের ভবিষ্যৎ সাপ!
** প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ
** যেখানে হারায় না শৈশব
** তিন মাস চা বিক্রেতা, নয় মাস মজুর
** ‘আমড়া বন্ধনে’ সম্ভাবনা বিশ্ব ছোঁয়ার
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’