বরিশাল, বাবুগঞ্জ থেকে ফিরে: ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে’। দূর থেকে কবিতার আওয়াজ কানে আসে।
ওই বিষয় থাক। ধান, নদী, খাল এবং রূপালি ইলিশের দেশের কথা বলি। সমৃদ্ধশালী এক ঐতিহাসিক জনপদ বরিশাল। এখানেই রয়েছে সেই বিখ্যাত দুর্গাসাগর। প্রাচীনকাল থেকে স্বতন্ত্র ঐতিহ্য বহন করে চলা এই জনপদের বাবুগঞ্জ উপজেলায় ৪৫ দশমিক ৫৫ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এ উদ্যান। পুরো দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ দিঘি রয়েছে উদ্যানটিতে।
বরিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে দুর্গাসাগরের পথ ১০ কী ১১ কিলোমিটার দূরের। বিশাল আকারের উদ্যান আর এতে সাগরসম দিঘি। এছাড়া ভেতরের দিকে ছোটখাটো একটি জঙ্গল। রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ ও বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু। আরও আছে দিঘিতে বড় বড় রুই-কাতলার সমারোহ। এছাড়া বড় আকর্ষণ- দিঘির মধ্যখানের ‘দ্বীপ’। হ্যাঁ সত্যিই তাই- দিঘিতেই দ্বীপ। একদিন-দুদিন নয় বহু কাল আগে থেকেই এমন দ্বীপ। জনসাধারণ দিঘিটির পাড় দর্শনের অনুমতি পেলেও নেই কৃত্রিম দ্বীপে প্রবেশের অধিকার। মৌসুমে দিঘির কিনারে পূজা-পার্বণের আয়োজন করা হয়।
উদ্যানের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশেই বিশাল বটগাছ। বটতলায় বসে রোজ ঝালমুড়ি বিক্রি করেন মো. মাহবুব হোসেন। বাংলানিউজকে জানান, ব্যবসা ভালোই হয় এখানে বসলে। যারা ঘুরতে আসেন তাদের চটজলদি ঝালমুড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। দাম মাত্র পাঁচ টাকা।
মাহবুব বলেন, আমার ঝালমুড়ি তো পাঁচ টাকা। কিন্তু এখানকার নির্মল বাতাস কোটি টাকা দিয়েও দেশের অন্য কোথাও কেউ খুঁজে পাবে না বটে। কোনো প্রকার দূষণ নেই, আছে শুধু মুক্তমনা প্রকৃতি। এখানে এসে প্রকৃতির ছোঁয়ায় যে কেউ হারাতে বাধ্য। আর শীতে এলে তো কথাই নেই। পাখির মিষ্টি জালাতন যেন মন কাড়বে।
মাহবুব সাহেব, কবিতা লিখেন নাকি? – না তো, কেন।
– কবি কবি কথা আপনার তাই!
ওদিকে আরেক কবির (জীবনানন্দ দাশ) কবিতা আবৃত্তি করছিলেন আরমান-শারমীন দম্পতি। তাদের সঙ্গে কথা হয় আগেই। দুর্গাসাগরের দিঘির বিশালতায় হারিয়ে যাওয়া দু’জন তারা। হাতে ছাতা, টিপটিপ বৃষ্টিতে ভালোবাসার মাদকতায় আরও রঙ এনেছে এখানকার চির সবুজ প্রকৃতি। সেই সঙ্গে নীল আকাশে মেঘের ভেলা।
এই উদ্যানের দেখভালের দায়িত্বে আছেন ল্যান্স নায়েক (অব.) জাহাঙ্গীর খান। তিনিসহ মোট চারজন কর্মী কাজ করেন। জেলা প্রশাসনের আওতাধীন এই কেন্দ্রটি। চারকর্মীর কেউ নিরাপত্তায়, কেউ টিকিটে এবং কেউ গেটে দায়িত্ব পালন করেন। ১০ টাকা টিকিটে প্রবেশ করতে হয় দর্শনার্থীদের। শীতের সময় পিকনিক স্পট হিসেবেও ব্যবহৃত হয় দুর্গাসাগর। সাধারণ সময়ে ৭০/৮০ জন প্রতিদিন গড়ে আসেন। শীতে এ সংখ্যা বেড়ে ২০০ ছাড়িয়ে যায়। বাংলানিউজকে এসব তথ্য জানান জাহাঙ্গীর খান। আরও নানা বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। উঠে আসে বিভিন্ন বিষয়।
জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে থেকেই দক্ষিণে বরিশালের ভূমিরূপ তৈরি হতে থাকে। তবে এ অঞ্চলে মানব বাসের বয়স সর্বোচ্চ ১০ হাজার বছর হতে পারে। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে ‘বাঙ’ জাতির বসবাস ছিল। যারা হযরত নূহ’র (আ.) প্রপৌত্র। ধারণা করা হয় বঙ’র বংশধররাই উত্তরকালে বাঙ জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে প্রাচীন ভারতবর্ষের ভেড্রি, অস্ট্রিক, আলপাইন, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে এক নতুন জাতির আর্বিভাব হয়। এই প্রচীন জনপদ সেই সময় থেকেই বেশ পরিচিত। বরিশালের আগের নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। যার রাজধানী ছিল মাধপপাশা। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্গাসাগর।
এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা বিষয়ে নাম ফলক থেকে জানা যায়, ১৭৮০ সালে দিঘিটি খনন করেন রাজা শিবনারায়ণ রায়। তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাজা। বাংলার বারো ভূঁইয়ার একজন। মাধবপাশায় বাকলা চন্দ্রদ্বীপে তাদের বাস ছিল। মগ জলদস্যুদের ভয়ে অথবা নদী ভাঙনে পটুয়াখালী থেকে এখানে চলে আসা তাদের। রাজা শিবনারায়ণ স্ত্রী দুর্গাদেবীকে বেশ ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসা এবং এলাকাবাসীর পানির চাহিদা পূরণে দক্ষিণ বাংলায় সর্ববৃহৎ দিঘি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি। এর নামকরণও হয়েছে রাজার স্ত্রীর নামের সঙ্গে মিল রেখে দুর্গাসাগর। আয়তন ২৫০০ হেক্টর। এর তিন দিকে রয়েছে ঘাট।
কথিত আছে, এক পূর্ণিমার রাতে দুর্গাদেবী যতদূর হাঁটতে পেরেছেন, ততটুকু জায়গা নিয়েই দিঘিটি খনন করা হয়েছে। রানী এক রাতে ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন। তৎকালীন তিন লাখ টাকা ব্যয় হয় দিঘি খননে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৪৫ দশমিক ৫৫ একর জমি জুড়ে দুর্গাসাগর। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৩৮ একর জলাশয়, ১৮ দশমিক ৪ একর স্থল জমি। ১৯৭৪ সালে দিঘিটি সংস্কার করা হয়। পাড়ে লাগানো হয় বিভিন্ন গাছপালাও।
বছরে একবার দিঘি সংলগ্ন মাধবপাশা বিদ্যালয় মাঠে মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেলায় আসেন মানুষ। দিঘির জলে জলকেলিতে মেতে ওঠেন। হয় পূজাও। এদিকে শীতকালে দিঘির শোভা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথি পাখির কলরবে মুখরিত হয় পুরো প্রাঙ্গণ। দিঘির জলে পাখির সাঁতার, হঠাৎ দল বেঁধে ওড়াউড়ি, ডানা ঝাপটানো এসবই পর্যটকদের সরল আনন্দ দেয়। দিঘির পশ্চিম পাশে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। বেড়াতে এলে রাত্রিযাপনের সুযোগও রয়েছে।
এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেহমনে প্রশান্তি এনে দিতে বাধ্য। দিঘির চার পাশে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে মন হারিয়ে যাবে তা টের পাওয়া ঢের কঠিন। এমন নিসর্গে যে কেউ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারেন। তাই তো চলে আসতে হবে এখানে- ঐতিহ্য আর ইতিহাসের কাছের প্রকৃতিতে। যেমনটি এসেছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ রেজা। তিনি মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্র। তার সঙ্গে আরও আসেন শান্তা, ইভা ও প্রত্যাশা। তারা তিনজন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের। বাসা সবার যশোর ও খুলনায়। এখানে মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। সময়-সুযোগ পেলেই দুর্গাসাগরে বেড়িয়ে যান। খুব ভালো লাগে এখানকার পরিবেশ জানান, আসিফ।
শান্তা, ইভা ও প্রত্যাশা বলেন, মানসিক শান্তির জন্য এখানে আসা দরকার। এছাড়া আমাদের কাছে দিঘির পানিতে পা ভেজানোর আনন্দই আলাদা। দিঘিতে পা ভেজানোর মজা আর ঠাণ্ডা বাতাসে চুলের ওড়াওড়ির সুখ আসলেই অন্য এক অনুভূতির।
এখন নেই রাজা, নেই রানীও। নেই রাজবংশের কেউ। এখানে ঘুরতে এলে নিজেই তো নিজের রাজা। দুর্গাসাগরের পশ্চিমে শ্রীপুর, পূর্বে কলাডোমা, উত্তর পাশে পাংশা, দক্ষিণে শালনা ও ফুলতলা গ্রাম। এই গ্রামগুলোও বেশ দেখার মতো অর্থাৎ গ্রামের মেঠো পথে হাঁটা যাকে বলে আরকি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের এই স্থানটি অনন্য দর্শনীয় হতে পারে। সে জন্য চাই আরও বিস্তর উদ্যোগ। সঙ্গে প্রচার-প্রচারণা। চাই সংস্কার, চতুর্মাত্রিক বৃক্ষায়ন, অতিথি পাখির নিরাপত্তা বেষ্টনী। হতে পারে মিনি সাফারি পার্কও। এমনটাই মত এখানে ঘুরতে আসাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫
আইএ
** ২ লাখের শ্রম-ঘামে অন্যতম মসজিদ উজিরপুরে
** বেদে পল্লী: ১৫ পরিবারে ২ বেড়ার টয়লেট
** এই শিশুদের ভবিষ্যৎ সাপ!
** প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ
** যেখানে হারায় না শৈশব
** তিন মাস চা বিক্রেতা, নয় মাস মজুর
** ‘আমড়া বন্ধনে’ সম্ভাবনা বিশ্ব ছোঁয়ার
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’