‘আরব্য রজনী’ বা ‘আলিফ লায়লা’র আখ্যানের টানে রোমাঞ্চিত বিশ্বব্যাপী মানুষ বোগদাদ, দামেস্ক নগরীর নাম জেনেছেন। প্রাচীনকালে প্যাপিরাসের জন্য মিশরের কথা জেনেছে মানুষ।
মাটির ফলকের লেখা আদি যুগের গ্রন্থ, প্যাপিরাসের বা তালপাতায় হাতে লেখা বইয়ের যুগ এবং যান্ত্রিক ছাপাখানায় লক্ষ লক্ষ কপি বইয়ের পর্যায় পেরিয়ে তাবৎ পৃথিবী এখন প্রবেশ করেছে ডিজিটাল যুগের ই-বইয়ের জগতে। আস্ত একটি লাইব্রেরি এখন মানুষের হাতের মুঠোয়-ধরা মোবাইল ফোনের ভেতরে স্থান পেয়েছে। যে কোনো জায়গা থেকে ইন্টারনেটের সুবাদে পৃথিবীর প্রধান প্রধান গ্রন্থাগারগুলোর বইপত্র পাঠ করাও এখন আর অসম্ভব নয়। এমন প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের সন্ধান করা আসলেই একটি রোমাঞ্চকর বিষয়।
উদ্ভবের দিক থেকে গ্রন্থাগারের ইতিহাস গ্রন্থের মতোই সুপ্রাচীন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঠিক কবে গ্রন্থাগার প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তার সঠিক ইতিবৃত্ত জানা দুরূহ। তবে অনুমান করা হয় যে, সুপ্রাচীন অ্যাসিরিয় সভ্যতায় গ্রন্থাগারের গোড়াপত্তন হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য-এশিয়া মাইনর কেন্দ্রিক অ্যাসিরিয়ান সভ্যতার অন্যতম রাজা আসুরবানিপাল (Assurbanipal) তার নিজস্ব সংগ্রহশালার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি একাধারে সেনাপতি ও যোদ্ধা, শাসক ও প্রশাসক এবং গ্রন্থপ্রেমী ও বাস্তব গ্রন্থাগারিক ছিলেন। এই রাজার ইতিহাস সম্পর্কে অনেকগুলো গবেষণায় যা বলা হয়েছে, তাতে তার গ্রন্থাগারিক পরিচিয়টি স্পষ্ট। একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে: Assurbanipal was first of all a warrior, then an administrator, and finally a librarian. মানবেতিহাসে আর কোনও শাসকের পরিচয় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার সময় গ্রন্থাগারিক-এর মর্যাদা আরোপ করা হয় নি, যেমনটি বলা হয়েছে অ্যাসিরিয় শাসক আসুরবানিপাল সম্পর্কে।
বিশ্বের প্রাচীনতম ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে আসুরবানিপাল-এর গ্রন্থাগারটি অন্যতম। তিনি তার সাম্রাজ্যের রাজধানী নিনেভহ-এ (Nineveh) একটি জাতীয় গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৮-৬২৬ অব্দে তার পিতামহ সেনাচেরিব কর্তৃক যে সংগ্রহের সূচনা হয়েছিল, উক্ত সংগ্রহের সঙ্গে আরও অনেক সংগ্রহ সংযোজন করে আসুরবানিপাল তার রাজধানী নিনেভহ-তে হাজার হাজার মাটির চাকতি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারটি গড়ে তুলেছিলেন। সে আমলে কাগজ আবিষ্কৃত হয় নি। এবং বই-পুস্তক-ফরমান-রাষ্ট্রীয় হুকুমনামা ইত্যাদি শক্ত মাটির চাকতিতে অঙ্কিত বা লিপিবদ্ধ হতো। সেগুলোই ছিল সভ্যতার ঊষালগ্নের সেই আদি পাঠাগারের প্রথম সংগ্রহ, যা ছিল আজকের আধুনিক বইয়ের আদিরূপ।
গ্রন্থপ্রেমী রাজার নামানুসারে ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থাগারটি ‘আসুরবানিপাল লাইব্রেরি’ নামে পরিচিতি। এ গ্রন্থাগারটি প্রায় ৩০ হাজার মৃন্ময়-চাকতি দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল। এগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১৫ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি এবং এক থেকে দেড় ইঞ্চি পুরু ছিল। আসুরবানিপাল লাইব্রেরিতে প্রায় দশ হাজার ধরনের উপকরণ সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আসুরবানিপালের প্রতিকৃতিসহ প্রায় ২০ হাজার চাকতি আলাদাভাবে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে। তাঁর লাইব্রেরিটি ছিল একাধারে চাকতি-পুস্তক ও সংগ্রহশালা। অর্থাৎ গ্রন্থাগার এবং মিউজিয়াম দুটোই ছিল একটি অভিন্ন ব্যবস্থাপনায়।
প্রত্নতাত্ত্বিকগণ গবেষণা ও উৎখননের পর জানা যায় যে, আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটি সুসজ্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। সেখানে ছিল অসংখ্য কামরা। সকল কামরায় বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য মৃন্ময় চাকতি শ্রেণিবদ্ধভাবে সাজানো ছিল। যার ফলে গ্রন্থাগার ব্যবহার সহজ ছিল। এ গ্রন্থাগারে ইতিহাস, শাসনতন্ত্র, বৈদেশিক তথ্য, ভূগোল, আইন, ব্যবসা ও রাজস্ব, বিজ্ঞান, পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মীয়, সাহিত্য ও রেফারেন্সসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সামগ্রী রক্ষিত ছিল। প্রাচীন অ্যাসিরিয়ায় ‘নাবু’ নামে ধর্মবিষয়ক এক দেবতা ছিল। তাকে God of writing বা ‘লেখার দেবতা’ বলা হতো। আসুরবানিপাল দেবতার কাছে তার গ্রন্থাগারের উন্নয়নের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন বলেও জানা যায়। দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আসুরবানিপাল কিছু কিছু সংগ্রহের মধ্যে নাবু নাম লিখে সিল লাগাতেন। আসুরবানিপাল গ্রন্থাগার সামগ্রী সংগ্রহের জন্য অসংখ্য লেখক এবং স্কলার নিযুক্ত করেছিলেন। তাছাড়া সংগৃহীত কপির নকল বা অধিক কপি তৈরির জন্য অনেক নকলনবিশ নিযুক্ত করেছিলেন, যাদেরকে ‘লিখিত চাকতির মানুষ’ বলা হতো।
আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটির পরিচালনা পদ্ধতি ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত; ফলে সুসংগঠিত এবং সুপরিকল্পিত। সেখানে গ্রন্থাগারিক, পরিচালক, পাঠক ও পণ্ডিত, বিদ্বান ব্যক্তি, ক্যাটালগার, নকলনবিশ ও অন্যান্য কর্মচারী সকলেই গ্রন্থাগার উন্নয়নের জন্য নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পরিশ্রম করতেন। কর্মচারিগণ উচ্চহারে সরকারি ভাতা ও বেতন এবং সম্মানজনক অবস্থান লাভ করতেন। আসুরবানিপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার, সরকারি এবং বেসরকারি, বিদেশি ও পর্যটক, গবেষক, পণ্ডিত ও বিদ্বান, ছাত্র ও শিক্ষক, তথা সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল, যাকে আধুনিক পাবলিক লাইব্রেরির পূর্বসুরী বলা যায়।
গ্রন্থাগারের প্রতিটি কক্ষের মালামালের ক্যাটালগ বা বর্ণনা প্রতিটি কক্ষের দেওয়ালে খোদাই করে লিপিবদ্ধ থাকতো। ক্লে ট্যাবলেটের বা মাটির চাকতির শিরোনাম, প্রত্যেক কাজের জন্য ট্যাবলেটের সংখ্যা, সারির সংখ্যা, গুরুত্বপূর্ণ শাখাসমূহ, অবস্থা ও শ্রেণীকরণের প্রতীক তালিকাভুক্ত করা হতো।
দুর্ভাগ্যবশত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে যেসব যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, তাতেই প্রকৃতপক্ষে অ্যাসিরিয় সভ্যতা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল এবং সমৃদ্ধ এ বিশাল গ্রন্থাগারটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পোড়া ইটের চাকতিগুলো এতোই শক্ত-পোক্ত ছিল যে, হাজার হাজার চাকতি আড়াই হাজার বছর পরেও ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটি ছিল অ্যাসিরিয় সভ্যতার প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আধুনিক গ্রন্থাগারের সঙ্গে উৎসগত দিক থেকে মিশে আছে এই সুপ্রাচীন গ্রন্থাগারের নাম ও স্মৃতি। অ্যাসিরিয় সভ্যতা নিয়ে যতগুলো ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা গ্রন্থ পরবর্তীকালে প্রকাশ পায়, তার সবগুলোতেই বিশেষ মর্যাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটির বহুবিচিত্র বর্ণনা ও বিবরণ।
গ্রন্থাগারের মতোই গ্রন্থেরও প্রাচীনত্ব। আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটিতে প্রাপ্ত ‘মাটির চাকতি’কে আদি গ্রন্থ-রূপ হিসাবে ধরা হলেও ঐতিহাসিকগণ জানাচ্ছেন যে, এরও বহু আগে মানুষ গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশের প্রয়াস পেয়েছিল। লিপি-কৌশল আয়ত্বে আসার আগেই মানুষ দড়িতে গিঁট বেঁধে বা কোনও কঠিন পদার্থের ওপর দাগ কেটে সঙ্কেত পাঠাতো। এর পরবর্তী স্তর চিত্রলিপি। মেক্সিকোর অ্যাজটেকরা, চিনের প্রাচীন অধিবাসীরা, মিশরের পিরামিটের দেওয়ালে কিংবা মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার অধিবাসীরা, সকলেই চিত্রলিপি ব্যবহার করতো। এ সময় কাঠের খণ্ডের ওপর অক্ষর খোদাই করার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, যাকে জাইলোগ্রাফি (xylography) বলা হতো। পরে যাজকরা বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে কাগজের ওপর কাঠ-খোদাই ছাপ তুলে বিতরণ করতেন। এ ধরনের কাগজখণ্ডকে একত্রিত অবস্থায় বাঁধাই করে ‘ব্লক বই’-এর সৃষ্টি হলো। কাঠ-খোদাই ছাপ চীন থেকে জাপান হয়ে কোরিয়া, তিব্বত ও নেপালে পৌঁছেছিল।
আজকের বইয়ের আদি সংস্করণ অ্যাসিরিয়ার আসুরবানিপাল গ্রন্থাগারের মৃন্ময় চাকতি, ছাপ, চিত্রলিপি বা ব্লক বইয়ের মতোই ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপে বিপুল সংখ্যক মৃৎপাত্রের গায়ে উৎকীর্ণ লিপি পাওয়া গেছে। ঋপদী গ্রিসের হেলেনীয় যুগে মৃৎপাত্রের লিপিসমৃদ্ধ গ্রন্থাংশের মতোই রাজকীয় গ্রন্থাগার, এমন কি, ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। অ্যারিস্টটলের বিদ্যালয় ‘লাইসিয়াম’-এর মতোই প্লেটোর স্কুল ‘একাডেমি’-তেও সুবিশাল গ্রন্থাগার ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রোমে ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থাকাটা সামাজিক প্রতিপত্তি ও আভিজাত্যের দ্যোতক ছিল।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারভিত্তিক জ্ঞানচর্চার অতি উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গ্রন্থাগারের বিবরণ এখনো ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার পরেও মানব সভ্যতার সহযাত্রী হয়ে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার আজকের উত্তরাধুনিক পৃথিবী পর্যন্ত এসে অনেকটা জায়গা নিয়েই টিকে রয়েছে এবং অনাগতকালেও যে টিকে থাকবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি ও লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, mahfuzparvez@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৭
জেডএম/