হঠাৎ সুযোগ করে গত বছর দেখেও এসেছি। কিন্তু এ নিয়ে লিখবো লিখবো বলে আর লেখাই হয়নি।
সত্যি বলতে, জাতীয় কবির জন্মভিটা ও পরিবার নিয়ে লিখতে বড় কষ্ট লাগে। এতো অবহেলিত পরিবার দুই বাংলার কোথাও রয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এখনও সংরক্ষণ করা হয়নি নজরুলের জন্মভিটা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও কোনো আর্থিক সহায়তা করেনি। সরকারের পক্ষ থেকে জন্মভিটায় নজরুল একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতা করার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। বাড়ির পাশে যে মক্তবে শিক্ষা নিয়েছেন সেটি নজরুল একাডেমি নামকরণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের আর্থিক সহায়তায় কোনোরকম দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাজী নজরুল যে ঘরে জন্ম নিয়েছেন সেটি আগের মতোই জীর্ণ-শীর্ণ ছনের ঘর। এ ঐতিহ্যটি কোনোরকমে ধরে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। অর্থের অভাবে তাও ঠিকমতো দেখভাল করা হয় না। সেখানে গিয়ে পরিবারের অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। এখনও তাদের সংসার চলে নিদারুণ কষ্টে। কাজী পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই এখনও দিন আনে দিন খায়। এই হলো আমাদের জাতীয় কবির পরিবার। দুই বাংলাতেই অবহেলিত নজরুল।
ভারতে নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুলকে তেমনভাবে উপস্থাপন করা হয় না। বাংলাদেশে যা ছিলো তা শুধু জাতীয় কবি উপাধি পর্যন্তই। তাকে নিয়ে রাজনীতি হয়। জন্মদিন-মৃত্যু দিবস পালন করা হয়। কিন্তু তার স্মৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা হয় না। এটা কী জাতীয় কবির প্রতি আমাদের অপমান নয়! আমি এ অবস্থা দেখে কবির উঠানে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এ এক হতদরিদ্র পরিবার। কাজী বাড়ির সবাই কোনো রকমে জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে রয়েছে। খেটে খাওয়া এমন দরিদ্র পরিবারে নক্ষত্রের মতো অর্বিভাব হয়েছিল নজরুলের। বেঁচে থাকার তাগিদে তিনিও কম সংগ্রাম করেননি। এতো বড় মাপের মানুষ ছিলেন। সত্যের পক্ষে শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছেন-লিখেছেন আজীবন। কিন্তু নানা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে তার পরিবার ও স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থান সবই অবহেলিত। বাংলাদেশ সরকারেরও কোনো উদ্যোগ নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলতে গেলে ভুলেই গেছে নজরুলকে।
হাজার হাজার কোটি টাকা কতো খাত-বেখাতে অপচয়-লুটপাট হয়। কিন্তু নজরুলের স্মৃতি রক্ষায় কোনো সরকার এগিয়ে আসে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার না করলেও বাংলাদেশের সরকার দু’দেশের সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে অন্তত জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত জন্মভিটাকে রক্ষা করতে পারে। শুধু জন্ম-মৃত্যু দিবসে সস্তা আবেগঘন রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে নজরুলের জীবন ও কর্মকে অপমানিত করার দরকার কী? জাতীয় কবির পরিবারকে সংবাদ সম্মেলন করে কেন বলতে হয়, ‘হে রাষ্ট্র আমাকে বাংলাদেশে থাকার জন্য এক টুকরো জমি দাও’। এটা কি আমাদের জাতীয় কবির জন্য লজ্জার নয়! কিন্তু তাই দেখলাম।
গত ২৯ এপ্রিল কবির ছোটছেলের পরিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে তাই জানালেন। বিভিন্ন আনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে তাদের বাংলাদেশে আনা হয়। কিন্তু থাকার জায়গা নেই। তাই বাংলাদেশে থাকার জন্য অন্তত এক টুকরো জায়গা চেয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছোটছেলে কাজী অনিরুদ্ধর পরিবারের সদস্যরা। সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানিয়েছেন অনিরুদ্ধর ছোট মেয়ে অনিন্দিতা কাজী।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গত বছর একটি লিখিত আবেদনও করেছেন বলে জানান কবির নাতনি। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। পুরো জাতির জন্য এটা লজ্জার।
এসব বলে শেষ হবে না। কীভাবে কাজী বাড়ি ঘুরে এলাম তা একটু বলি। গত বছর এমন দিনে কলকতায় গিয়ে পরের দিনই ট্রেনে ছুটে গেলাম প্রিয় কবির বর্ধমান জেলার সেই আসানসোলের ছোট্ট শহরে। অন্যরকম গ্রামীণ পরিবেশ। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার পথ গ্রাম আর সবুজ মাঠ পেরিয়ে কয়লা আচ্ছাদিত পাহাড় বেষ্টিত বর্ধমান। যেদিকে তাকাই সেদিকেই কয়লা আর কয়লা। দেখে মনে হয়েছে, কয়লায় পরিণত হয়েছে গোটা এলাকা। আল্লাহর কী বিচিত্র সৃষ্টিজগত। আসানসোল থেকে বাসে একেবারে নজরুলের বাড়ির সামনে পৌঁছালাম। তখন দুপুর। পাশের স্কুলটি ছুটি হয়েছে। চুরুলিয়ায় বাস থেকে নেমেই চা দোকানদারকে নজরুলের বাড়ির কথা বলতেই তিনি বললেন, দুই মিনিটের পথ। ওই যে কাজী বাড়ির মেয়েরা যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে যান। স্কুল ছুটি হয়েছে, তারা বাড়ি যাচ্ছে।
কথা বললাম। নামগুলো এখন আর মনে করতে পারছি না। পরিবার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। কষ্টে চলে তাদের সংসার। একজনের বাবা খেতে কাজ করতে গেছে। আর এক জনের বাবা শহরে কাজের উদ্দেশ্যে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের। প্রতিটি পরিবারের অবস্থা একইরকম দেখলাম। যাইহোক তারপরও কোনোরকমে জীবন চলে যাচ্ছে।
নজরুলের জন্মভিটায় গিয়েই দেখা হলো কবির ছোট চাচার ছেলে কাজী মাজাহার হোসেনের সঙ্গে। হাসি মুখে বসতে দিলেন। গল্প করলেন। অনেক অজানা কথা জানালেন। কাদের সহযোগিতায় চলছে নজরুল একাডেমি? এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, কিছু মানুষের আর্থিক সহায়তায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ স্থানটি সংরক্ষণ ও নজরুল একাডেমির দায়িত্ব নেবে বলে শুনেছি। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
কাজী নজরুল ইসলামের মক্তবটি এখন নজরুল একাডেমি। তিনতলা ভবন। কাজী মাজাহার হোসেন প্রিয় কবির বাড়ি এবং তার স্মৃতিময় স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখালেন। বাড়ি থেকে একটু সামনেই রয়েছে হাই স্কুল। রয়েছে খেলার মাঠ। ওই মাঠের উত্তর প্রান্তেই কবির পারিবারিক কবরস্থান। যেখানে কবির পিতা কাজী ফকির আহমদ, মা জাহিদা খাতুন ও কবির সন্তান এবং স্ত্রী প্রমিলা দেবীর সমাধি। রাস্তার মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে কবির প্রতিকৃতি। কবরস্থানের ৩০ গজ পূর্ব দিকে রয়েছে মসজিদ— নজরুল যে মসজিদে আজান দিতেন এবং মাঝেমধ্যে ইমামতি করতেন। তার বাবা নামাজ পড়াতেন।
কবির বাড়িটি ছিলো খড়ের ঘর। যা আজও সংরক্ষণ করছে পরিবারের সদস্যরা। বাড়ির প্রবেশপথে দেয়াল ইটের। অনেক বড় কাজী পরিবার। এখানেই কবির আত্মীয়স্বজনরা বসবাস করেন। নজরুলের মক্তবটি নজরুল একাডেমি। এটির নিচতলায় লাইব্রেরি, অফিস কক্ষ, সম্মেলন কক্ষ এবং জাদুঘর। জাদুঘরে কবির লেখা পাণ্ডুলিপি, তার ব্যবহৃত কলম, জামা-কাপড়, থাকার চৌকি, বাদ্যযন্ত্রগুলো রয়েছে। দ্বিতীয়তলায় একাডেমির পাঠ কক্ষ, সঙ্গীত চর্চার জন্য কক্ষ এবং তৃতীয়তলায় আবাসিক কক্ষ। অতিথিদের থাকার জন্য কক্ষ রয়েছে কয়েকটি। প্রতিনিয়ত বহু গবেষক এবং পর্যটক আসেন এ বাড়ি দর্শনে। কবির চারণভূমি দেখলাম। আর মনে মনে ভাবলাম, এই গাছের নিচে এই পথে বসে হয়তো কবি বিশ্রাম নিয়েছিলেন বা বাঁশি বাজিয়েছেন। অথবা এই পথে দৃপ্ত পায়ে কবি হেঁটেছেন।
শিশুকালে যিনি আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়েছেন। জীবনের শুরুতেই আমরা যার কবিতা আবৃত্তি করেছি ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি জাগি’! যিনি শুধু আমাদেরই ঘুম থেকে জাগাননি, বাঙালিকে তথা সমগ্র ভারতবাসীকে জাগিয়েছেন তিনি জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহী কবিতা লিখে আমাদের মনে বিপ্লবের বীজ বপন করেছেন। আগামী ২৫ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ) কবির জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের এই দিনে তিনি জন্ম নেন। পরপারে আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুক। আজ শুধু মনে পড়ছে তার লেখা সেই লাইনগুলো—
“উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ। ”
মাহবুব মাসুম, সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৭ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৭
এসএনএস