ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের ব্যবচ্ছেদ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৮ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৭
ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের ব্যবচ্ছেদ মুর্শিদাবাদ ১৭৯০

২৩ জুন ১৭৫৭ সালকয়েক ঘণ্টারতথাকথিত-যুদ্ধনামের প্রহসনে পাল্টে গেল বাংলার এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্যযুদ্ধের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ধারার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পলাশীর ২৬০ বছর পূর্তিতে পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ। পড়ুন দশম পর্ব।

পলাশীর যুদ্ধ কিংবা ষড়যন্ত্র, উভয়টিই পরবর্তী গবেষণার উৎকৃষ্ট বিষয়রূপে পরিগণিত হয়েছে। এতো অল্প সময়ে, এতো অল্প ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে, কিভাবে বড় একটি সৈন্যদের পরাজিত করা এবং কালক্রমে দেশের সকল ক্ষমতা হস্তগত করা সম্ভব হয়েছে, তা শুধু বিষ্ময়করই নয়, বিরাট গবেষণারও বিষয় বটে।

 

তৎকালীন ইতিহাসের নানা সূত্রমতে, ১৭৫৭ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে ক্লাইভ কলকাতা থেকে রওয়ানা হয়ে ১৭ তারিখে পলাশীর দক্ষিণে অবস্থিত কাটোয়া শহরে পৌঁছেন ও সেখানকার দুর্গ অধিকার করেন। পথে নবাবের বহু সেনা ছাউনির দেখা মিললেও কেউ ক্লাইভকে বাধা দেয় নি। বলা যায়, ক্লাইভ এমন পরিস্থিতির সৃষ্ট করেছিলেন যে, এক প্রকার বিনা বাধায় তিনি পলাশীর প্রান্তরে নবাবের মুখোমুখি হন। মীর জাফর

২১ জুন অপরাহ্ন ৪টার সময় ক্লাইভ কাটোয়া থেকে রওয়ানা হয়ে হুগলি নদী পার হন এবং ২৩ জুন সকালে পলাশীর প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। নবাবের সৈন্যবাহিনীকে তখন দেখা যাচ্ছিল। কামানের গোলা থেকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ইংরেজগণ নবাব শিবির আক্রমণ করে কিন্তু আমির মীর মদন (থনটন সাহেব তাকে মুদুম খান বলে অভিহিত করেছেন) বীর বিক্রমে বাধা দেন। বেলা প্রায় ১২টার সময় মীর মদনকে কামানের গোলায় আহত অবস্থায় নবাবের শিবিরে আনার কিছুক্ষণ পর তাঁর মৃত্যু হয়। মোহনলাল সে সময় মীর মদনের স্থান গ্রহণ করে যুদ্ধ চালাতে থাকেন। ষড়যন্ত্রের আশংকায় নবাব এ সময় মীরজাফরকে শিবিরে ডেকে পাঠান। মীরজাফর যুদ্ধে কোনই অংশগ্রহণ করেনি। নবাবের ঐকান্তিক অনুরোধে অবশেষে নবাব কর্তৃক মোহনলালকে অবিলম্বে যুদ্ধ থেকে বিরত করার শর্তে মীরজাফর পরদিন সকালে যুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সিরাজ সম্মত হন। মোহনলাল শিবিরে ফিরে আসেন। সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা নিরাশ হয়ে পলায়ন করতে থাকে। সন্ধ্যার পূর্বেই নবাবের সৈন্যরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ‘এই প্রকার তথাকথিত যুদ্ধে ভারত স্বাধীনতার সূর্য হারিয়েছিল’, ব্লকম্যানের তারিখ-ই-মনসুরীতে উপরিউক্ত মন্তব্য রয়েছে।

সিয়ার-উল-মুতাখখিরিনে বলা হযেছে, ইংরেজরা মীরজাফর-জগৎশেঠের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু যুদ্ধ সমাসন্ন, তাই ক্লাইভের গতিবিধি লক্ষ্য করে নবাব অসন্তুষ্ট সেনাপতিদের সঙ্গে বিরোধ দূর করার চেষ্টা করেন। এরা বাহ্যত আনুগত্য প্রকাশ করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে নবাবের ধ্বংসের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। প্রতিরোধ-প্রাকার ও ঘাঁটি তৈরি তত্ত্বাবধানের জন্য সিরাজ আগেই বিশ্বাসঘাতক দুলাব রামকে (রায়দুর্লভ) প্রেরণ করেন এবং স্বল্পকাল পরে সৈন্যাধ্যক্ষদ্বয় মীর মদন ও মোহনলাল এবং বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে নিয়ে নবাব নিজে পলাশী যান। ক্লাইভও আন্দাজ দু’হাজার সৈন্যসহ পলাশী ছিল। ক্লাইভ কামান থেকে গোলাবর্ষণ করে যুদ্ধ আরম্ভ করে। মীরজাফর দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। অপরাহ্ন প্রায় তিনটা পর্যন্ত মীর মদন বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। মোহনলালও ক্লাইভের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। এদের বীরত্ব ও আন্তরিকতা লক্ষ্য করে ক্লাইভ নিরাশ হয়ে উমিচাঁদকে ভর্ৎসনা করে। কারণ এরা ক্লাইভকে বলেছিল, সকলেই নবাবের প্রতি অসন্তুষ্ট এবং কেউই তার পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করবে না। পলাশীর যুদ্ধ

দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় কামানের গোলার আঘাতে মীর মদন আহত হন এবং তাকে নবাবের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মীর মদনের মৃত্যু হয়। এই সময় সিরাজ উৎকণ্ঠিত হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে যুদ্ধ করার জন্য মিনতি করেন। এমনকি, মীর জাফরের সামনে পাগড়ি রেখে নবাব সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই করুণ আবেদনেও মীর জাফরের মন বিগলিত হয়নি। বরং মীরজাফর বন্ধুত্বের মুখোশে তার বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ মতলব ঢেকে রেখে এই মিথ্যা উত্তর দেয় যে, “আজ দিন অবসানপ্রায়। আর যুদ্ধের সময় নাই। আজ যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দিন। আগামীকাল আমি সমগ্র সৈন্যবাহিনী নিয়ে আপনার পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করব। ”

মীরজাফরের ফাঁদে পা দিয়ে সিরাজ যুদ্ধরত মোহনলালকে ফিরে আসতে সংবাদ দেন। মীর মদনের মৃত্যুর পর মোহনলাল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মোহনলাল বলে পাঠান যে, তিনি এখন ঘোরতর যুদ্ধে ব্যস্ত, এতেই ভাগ্য নির্ধারিত হবে। সুতরাং এখন তার ফিরবার সময় নেই। সিরাজ আবার মীরজাফরের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মীরজাফর ধূর্তের মতো পূর্বের পরামর্শ পুনরুক্তি করে। তখন মোহনলালকে ফিরে আসার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। মোহনলালের প্রত্যাবর্তনে সিরাজের সৈন্যবাহিনীর ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সৈন্যরা চারদিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সিরাজ তখন দ্রুত মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন এবং কিছুক্ষণ মনসুরাবাদে অবস্থানের পর নিজেকে মিথ্যাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক সভাসদ দ্বারা পরিবৃত্ত দেখে বেগম পরিবার ও সভাসদসহ ভগবানগোলা যাত্রা করেন। সেখান থেকে নৌকাযোগে আজিমাবাদ রওয়ানা হন এবং ফরাসি সেনাপতি মঁসিয়ে ল’কে তার সঙ্গে যোগদানের জন্য এক পত্র প্রেরণ করেন। ল’ পৌঁছবার পূর্বেই তিনি পাটনা অভিমুখে রওয়ানা হন। বেগম ও পরিবারবর্গ কয়েকদিন যাবত অনাহারে থাকায় তিনি রাজমহলে নেমে দানশাহ নামক এক ফকিরের বাড়ি যান। ফকির বাহ্যত খিচুড়ি তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পূর্বের অসদ্ব্যবহারের জন্য নবাবের প্রতি তার ক্রোধ ছিল। ফকির সিরাজের উপস্থিতির সংবাদ তৎক্ষণাৎ রাজমহলে মীরজাফরের ভ্রাতা মীর দাউদের নিকট পাঠান। মীর জাফরের জামাতা মীর কাশিম এসে সিরাজকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায়, সেখানে মীরজাফর ও তার পুত্র মীরন হন্তারক মোহাম্মদী বেগের দ্বারা সিরাজকে হত্যা করে। সিরাজের মৃতদেহ হাতির পিঠে চাপিয়ে শহরে প্রদর্শন করা হয়।

যুদ্ধের সকল বিবরণে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও কয়েকটি বিষয় ছিল স্পষ্ট। যেমন, নবাব যুদ্ধের ময়দানে প্রচণ্ডভাবে সিদ্ধান্তহীন ছিলেন। তদুপরি তিনি তার প্রতি অনুগতদের বদলে আস্থা রেখেছিলেন ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি। সামরিক কৌশলের দিক থেকে সিরাজের পদক্ষেপ ছিল ভ্রান্ত। ঠাণ্ডা মাথায় স্থির ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বদলে তিনি উত্তেজিত ভাবে ইংরেজদের মুখোমুখি হওয়ার সময় অগ্র-পশ্চাৎ সব দিক সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেন নি। বরং ষড়যন্ত্রকারীরাই নিজেদের পরিকল্পনা মতো নবাবকে ইংরেজের মুখে দাঁড় করিয়ে পরাজয়ের পথে ঠেলে দেয়। সে পথে গমন ভিন্ন সিরাজ বিকল্প প্রতিরোধের ব্যবস্থাও করতে পারেন নি। এমন কি, পলায়ন ও আশ্রয়ের কোনও পরিকল্পনাও তিনি ঠিক রাখতে পারেন নি। চক্রান্তকারীদের ছকের ভেতরেই ঘুরপাক খেয়ে বন্দি হন এবং পরিশেষে করুণভাবে জীবন উৎসর্গ করেন। মুর্শিদাবাদে মহররম, ১৭৯০

সিরাজের চরিত্রের কতিপয় দুর্বলতা, রাজপুরুষদের ষড়যন্ত্র এবং উচ্চাভিলাসী ক্লাইভের তৎপরতায় একটি প্রহসনের যুদ্ধে বিরাট পরাজয় ঘটে সমগ্র বাংলার। ক্লাইভ প্রচণ্ড লুটপাটের মাধ্যমে বাংলাকে নিঃস্ব করে ফেলে এবং মীরজাফর প্রমুখ সুবিধাবাদীরা ক্লাইভের দাবি মেটাতে গিয়ে ফতুর হয়ে পড়ে। ষড়যন্ত্রকারীদেরকে নানাভাবে ব্যবহার করে ক্লাইভ ক্রমেই ব্রিটিশ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে আগ্রহী হয়। মীরজাফর প্রমুখের পক্ষে মুখ বুজে সব সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। পরবর্তীকে মীরজাফরের জামাতা মীর কাশেম ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসেন এবং বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ করে স্বাধীনচেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু তত দিনে আর কিছুই করা সম্ভব ছিল না। কারণ, রাজনৈতিক পাশার সকল চালই তখন ক্লাইভের মুষ্টিতে। ক্লাইভের ইঙ্গিতেই তখন আবর্তিত হচ্ছে বাংলার ক্ষমতা কাঠামো ও রাজনীতি। ক্লাইভ পরিগণিত হন তৎকালীন বাংলার রাজনীতির প্রধান পুরুষ।

পরবর্তী পর্ব
কে এই ক্লাইভ?

পূর্ববর্তী পর্ব
পলাশী-পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদল

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।