মসজিদটির অবস্থান প্রাচীন গৌড় নগরীর দক্ষিণ প্রাচীরে কোতোয়ালী দরজা থেকে মাত্র ৩ কি.মি দক্ষিণে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে ফিরোজপুর মৌজায়।
১৮৮০ সালে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম পরিদর্শনে এসে মসজিদটির গায়ে সোনালী পদার্থের কারুকার্যময় শৈল্পিকতার নমুনা দেখতে পান।
ছোট সোনা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে মসজিদটি সম্পর্কে এভাবেই শিক্ষার্থীদের জানাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ আবু তোয়াব শাকির।
এ সময় তিনি মসজিদের কেন্দ্রীয় দরজায় বিদ্যমান একটি শিলালিপি দেখিয়ে বলেন, এই শিলাপিলি থেকে জানা যায়, আলীর পুত্র মজলিস-ই-মজলিস, মজলিস-ই-মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। শিলালিপিতে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নাম উৎকীর্ণ। এ থেকে ধারণা করা হয়, ১৪৯৩-১৫১৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
লিপির মাঝের পংক্তিতে ৩টি কারুকার্যময় বৃত্ত রয়েছে। মাঝের বৃত্তের ভেতরে ‘ইয়া আল্লাহ’ ডানদিকে ‘ইয়া হাফিজ’ এবং বামদিকের ‘ইয়া রাহিম’ কথাগুলো আরবী হরফে অতি সুন্দরভাবে উৎকীর্ণ।
মসজিদের বাইরের দেওয়ালে বিশেষ করে সামনের দেওয়ালে অতি মনোরম কারুকার্য করা আছে। পোড়ামাটির চিত্রফলকের অনুকরণে এসব অলঙ্করণের কাজ পাথরের উপর করা হয়েছে। লতাপাতা, গোলাপফুল, ঝুলন্ত শিকল ও ঘণ্টা ইত্যাদির প্রতিকৃতিসহ নানা রকমের অলঙ্করণের কাজ মসজিদের গায়ে করা হয়েছে।
এ সময় অধ্যাপক মো. এমরান জাহান শিক্ষার্থীদের জানান, মসজিদটির বাইরের দিকে দৈর্ঘ্য ৮২ ফুট ও প্রস্থ ৫২ ফুট এবং ভিতরের দিকে দৈর্ঘ্য ৭১.৯ ফুট ও প্রস্থ ৪০.৬ ফুট। মসজিদের প্রাচীরগুলো প্রায় ৬ ফুট প্রশস্ত। দেওয়াল মূলত ইটের তৈরি। কিন্তু বাইরে সম্পূর্ণ পাথরে আবৃত।
মসজিদের চারকোণায় চারটি অষ্টকোণাকৃতি মিনার রয়েছে। মিনারগুলো বিরাট আকারের এবং এগুলোতে ধাপে ধাপে অতি মনোরম বলয়াকারের স্ফীতরেখায় অলঙ্করণের কাজ করা হয়েছে।
মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালে ৫টি মেহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মেহরাবটি অন্যান্য মেহরাব থেকে বড়। মেহরাবগুলোতে যে সব অলংকার রয়েছে সেগুলো অত্যন্ত উচুঁমানের। এই মেহরাবগুলোর মধ্যে একটি মেহরাবের অলংকৃত পাথর লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে কথিত রয়েছে।
মসজিদের পূর্ব দেওয়ালে আছে ধনুকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত ৫টি প্রবেশ পথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে তিনটি করে প্রবেশ পথ রয়েছে।
মসজিদটিতে মোট ৮টি স্তম্ভ রয়েছে এবং ১৫টি গম্বুজ রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশ দ্বারে এবং কেন্দ্রীয় মেহরাবের মধ্যবর্তী স্থানে ৩টি গম্বুজ চৌচালা ঘরের ছাদের আকারে নির্মিত। অবশিষ্ট ১২টি গম্বুজ অর্ধগোলাকার। গম্বুজগুলোর বৈশিষ্ট হল যেদিক থেকে তাকানো হোক না কেন, ৫টির বেশি গম্বুজ একসঙ্গে দেখা যায় না। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম গম্বুজের নিচে একটি রুম ছিল যেখানে নারীরা পৃথকভাবে নামাজ পড়ত।
মসজিদের পূর্ব দিকের তোরণ থেকে সামান্য পূর্ব-উত্তর দিকে (দৈর্ঘ ১৫ ফুট ও প্রস্থ ১০.৫ ফুট আয়তনের) মঞ্চাকারে নির্মিত একটি উচু বেদীতে ২টি পাশাপাশি বাঁধানো কবর রয়েছে। কবরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ লিপিতে কোরআনের বাণী রয়েছে।
সহকারী অধ্যাপক মাসুদা পারভীন বলেন, কবর দুটি মসজিদ নির্মাতা ওয়ালী মোহাম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। মসজিদের প্রাচীরের মধ্যে দুটি কবর রয়েছে। একটি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের, অন্যটি বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের।
মসজিদের উত্তর দিকে একটি মাঝারি আকারের দীঘি রয়েছে। এই দীঘির উত্তর-পূর্ব দিকে একটি বাঁধানো ঘাট ছিল, যেখানে মুসুল্লিরা ওজু করতেন। এক সময় দিঘীর পানি খুবই পরিষ্কার ছিল। কিন্তু বর্তমানে মানুষের মলমূত্র এই দীঘিতে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দীঘির চারপাশে অবৈধ স্থাপনা গড়ে এর সৌন্দর্য নষ্ট করা হচ্ছে বলে এই অঞ্চলের দায়িত্বরত এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, স্থানীয়রা দীঘির চারপাশে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে এবং মানুষের বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে এই দীঘিতে ফেলছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এদিকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ছাগল ও গরু স্থাপনার ভেতরে অবাধে বিচরণ করছে।
এ বিষয়ে গৌড় অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দায়িত্বরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে বলেন, মসজিদের একদিক উন্মুক্ত থাকায় স্থানীয়দের ছাগল-গরু প্রবেশ করছে। মসজিদের জন্য প্রকল্পের কিছু টাকা এসেছে। কিন্তু অবৈধ স্থাপনার জন্য কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।
এছাড়া তিনি বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে ছোট সোনা মসজিদটিকে দেখতে বাইপাস মহাসড়কের দাবি জানান। একই সঙ্গে ঢাকা-শিবগঞ্জগামী ডে-নাইট বাস সার্ভিস চালুর আহবান জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৭
জেডএম/