এ পথ ধরেই খানিকটা এগুলে ১৫শ শতাব্দীর বীরভদ্র মন্দির।
মন্দির যেতে মাইলখানেক আগে গ্রানাইটে গড়া বিশালাকৃতির ষাঁড়।
ষাঁড়টির পৌরাণিক নাম ‘নান্দী’। এক কথায় তার পরিচয় হলো, তিনি পূণ্যস্থান কৈলাসের দ্বাররক্ষী। কৈলাস চূড়াতেই ধ্যান করেন লর্ড শিব। সংস্কৃত নান্দী (বাংলায় উচ্চারণ নন্দী) শব্দের অর্থ খুশি, আনন্দ ও পরিতৃপ্তি। শিবের যাবতীয় সহায়-সম্পত্তির রক্ষকও নান্দী। অধিকাংশ শিব মন্দিরে বসে থাকা অবস্থায় মূল মন্দিরের দিকে মুখ করা একটি নান্দীর ছবি বা প্রতিকৃতি থাকে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যভেদে তাকে নান্দীকেশ্বর, নান্দীশ্বর, শালঙ্কায়ন বা থাণ্ডবা তালিকা বলে ডাকা হয়।
শৈব ধর্ম অর্থাৎ শিবের অনুসারীদের মতে, নান্দীনাথ সম্প্রদায়ের আট শিষ্য- শঙ্ক, সনাতন, সনান্দন, সনতকুমার, তিরুমুলার, ব্যগ্রপদ, পতঞ্জলি ও শৈবযোগদের গুরু হলেন এই নান্দী। তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এই আটজন আটদিকে বেরিয়ে পড়ে শৈব ধর্ম (শৈবিজম) প্রচারে।
নান্দী আগমিক ও তান্ত্রিক জ্ঞান লাভ করেছিলেন দেবী দূর্গার কাছ থেকে, প্রত্যক্ষভাবে যাকে শিখিয়েছিলেন স্বয়ং শিব।
ফিরে আসি লেপাকশি গ্রামে। লেপাকশি গ্রামের সঙ্গে জটায়ু পাখি তথা রাবণ-রাম-সীতার গভীর সংযোগ রয়েছে বলে লোকবিশ্বাস। সীতাকে বাঁচাতে জটায়ু রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, রাবণের হাতে প্রাণ দেওয়া জটায়ুর মরদেহ পড়েছিল এই গ্রামেই। ভিন্ন এক কারণে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন নান্দীও।
পুরাণ বলছে, সেসময় নান্দী রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তার সাম্রাজ্য ও সাধের লঙ্কা একদিন এক বানরের হাতে পুড়বে। সেই অভিশাপ সত্যিও হয়। পরবর্তীতে হনুমান সীতার খোঁজে লঙ্কা গিয়ে কোথাও খুঁজে না পেয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
নান্দী হলেন ‘গণ’দের একজন। গণ হলো শিবের পরিচারক যারা কৈলাসে বসবাস করে। শিব গণদের দলনেতা বানান তারই পুত্র গণেশকে। এখান থেকে তার নাম গণেশ এবং আরেক নাম গণ+পতি অর্থাৎ গণপতি।
শিবের খুব প্রিয় গণদের একজন নান্দী। এজন্যই তাকে কৈলাসের দ্বাররক্ষী বানিয়েছেন। শিব ঋষি শৈলদাকে তার আরাধনায় তুষ্ট হয়ে নান্দীকে পুত্র হিসেবে বর দেন। এ থেকেই বোঝা যায় নান্দীর গুরুত্ব। শৈব ধর্মের পতাকায় ব্যবহৃত হয় নান্দীর বসে থাকা ছবি। অবশ্য তার গুরুত্ব এখানেই শেষ নয়। ঐতিহাসিকভাবেও রয়েছে নান্দীর গুরুত্ব। সিন্ধু সভ্যতার সময়ও শিব ও নান্দীর পূজা করা হতো। শুভ প্রতীক হিসেবে শিবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহৃত হতো নান্দীরও ছাপ।
নৃতাত্ত্বিকদের মতে, সেই সময়কার বিখ্যাত ‘পশুপতি সিল’-এ পশুপতি তথা শিবের সঙ্গে ষাঁড়ের ছাপ মেলে। এছাড়া মোহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা থেকে পাওয়া অসংখ্য জিনিসত্রে ষাঁড়ের ছাপ পাওয়া যায়, যা দেওয়া হতো মূলত নান্দীভক্তি থেকে। পরবর্তীতে তিন শতাব্দীর স্বর্ণমূদ্রায়ও শিবের সঙ্গে নান্দীর ছাপ পাওয়া যায়।
মজার ব্যাপার হলো, অতি গরুত্বপূর্ণ নান্দীর সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য কৈলাসে নয়, লৈপাকশিতে। বরং হওয়ার কথা ছিলো কৈলাসে কারণ, তিনি সেখানকার দ্বাররক্ষী। যাইহোক, দাফতরিকভাবে লেপাকশির ২৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট উচ্চতার এ স্থাপত্য নিদর্শনটিই ভারতের সবচেয়ে বড় মনোলিথিক নান্দী। সেই সিন্ধু সভ্যতা থেকে এখনও দাপটের সঙ্গে কৈলাস পর্বতের পাশাপাশি ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব এবং শৈব ধর্মেরও রক্ষী হয়ে রয়েছেন।
লেপাকশি অর্থাৎ যেখানে সবচেয়ে বড় নান্দীর ভৌগলিক অবস্থান, সেটি অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের অনন্তুপুর জেলার একটি গ্রাম। এ রাজ্যের দু’টো রাজধানী- হায়দ্রাবাদ ও অমরাবতী। হায়দ্রাবাদ যদিও তেলেঙ্গানা রাজ্যেরও রাজধানী। বলে রাখা ভালো, তেলেঙ্গানা ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যেই ছিলো।
কাজেই লেপাকশি যাওয়া যাবে অমরাবতী ও হায়দ্রাবাদ দুই রাজধানী শহর থেকেই। হায়দ্রাবাদ থেকে ৪৮৫ কিমি এবং অমরাবতী থেকে লেপাকশির দূরত্ব ৫৭৩ কিমি। যাওয়া যাবে ট্রেন, বাস বা কার ভাড়া করে।
তবে অন্ধ্রপ্রদেশে গ্রাম হলেও লেপাকশি যাওয়া সবচেয়ে সহজ ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে। এখান থেকে দূরত্ব মাত্র ১২০ কিমি। ব্যাঙ্গালোর যদিও কর্ণাটকা রাজ্যের রাজধানী।
তবে ব্যাঙ্গালোর থেকে লেপাকশি ট্রেন-বাসে যাওয়াটা বেশ হ্যাপাই হবে। সহজ হবে কার ভাড়া করে গেলে। শহর থেকে বিভিন্ন রেন্টাল কার বা ওলা-উবারে যাওয়া-আসা যাবে। সময় লাগবে সর্বোচ্চ আড়াই ঘণ্টা। গাড়ি হিসেবে প্রতি কিমি নয় থেকে সর্বোচ্চ বারো রুপি পড়বে। ওলা-উবার ক্যাবে কোনো ওয়েটিং চার্জ নেই। সেই হিসেবে সর্বনিম্ন ২৩শ রুপিতে ঘুরে আসা যাবে লেপাকশি গ্রাম।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৭
এসএনএস