রূপকথার রাজ্যে দেখা মেলে প্রাচীন ও শক্তিশালী এ নগরীর পতন, রাজা অ্যাগামেননের নেতৃত্বে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ও গ্রিক সৈন্যদের বিজয়ের গল্প। ইলিয়াডে এই যুদ্ধকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ট্রোজান যুদ্ধ নামে।
ইলিয়াডের কাহিনী মতে, স্পার্টার রানী হেলেনকে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস অপহরণের কারণে ট্রোজান যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে মানুষের পাশাপাশি পৌরাণিক দেব-দেবীদের অংশগ্রহণের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
ট্রয় বলতে বাস্তবের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের কথাও নির্দেশ করা হয়, যার অবস্থান বর্তমান তুরস্কের উত্তর উপকূলে। এই স্থানের আধুনিক নাম হিসারলিক। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এটাই রূপকথার সেই ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ। তবে আসলেই ট্রোজান যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিলো কিনা, তা তর্কের বিষয় হিসেবেই থেকে যায় অনাদিকাল।
ধারণা করা হয়, হোমারের ইলিয়াডে খ্রিস্টপূর্ব ১৩শ থেকে ১১শ সালের ট্রয় নগরীর কথা বলা হয়েছে। এসময় প্রাচীন গ্রিকজাতি তুরস্কের পশ্চিম উপকূলে উপনিবেশ তৈরি করে। সুতরাং বলা যায়, এসময় ট্রোজানদের সঙ্গে গ্রিক জাতির সংঘাত ঘটা অসম্ভব কিছু না। ১৯ শতাব্দীতে এ ধারণাটা আরও পোক্ত হয় যখন জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক হেইনরিশ শ্লিমান হিসারলিকে রাজা প্রিয়ামের ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী খুঁজে পেলেন। ট্রোজান যুদ্ধ চলাকালে ট্রয়ের শাসনকর্তা ছিলেন রাজা প্রিয়াম।
তাম্র যুগের একদম শেষভাগে ট্রোজান যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এদিকে ট্রোজান যুদ্ধের বক্তা হোমারের জন্ম আরও চারশ বছর পর। ইলিয়াডের আগে ট্রোজান যুদ্ধ সম্পর্কিত কোনো দলিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইলিয়াড পরবর্তী নিদর্শনটা খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এথেন্সের শাসক পেসিসট্রেটাসের লেখনীতে। পরবর্তীতে গ্রিক কবি হেরোডোটাস, সোফোক্লিস এবং রোমান কবি ভার্জিলের কারণে গ্রিক সাহিত্য ও রোমান সাহিত্যের একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে ট্রয়ের যুদ্ধ।
কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে শুধু ট্রোজান যুদ্ধই ট্রয় নগরী পতনের একমাত্র কারণ না। অতীতে ট্রয় নগরী একাধিকবার ধ্বংস হয়েছিলো এবং পুনরায় গঠিত হয়েছিলো। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ট্রয়ের ৯টি ভিন্ন ভিন্ন স্তর খুঁজে পেয়েছেন, যা ট্রয় নগরীর সুদীর্ঘ উজ্জ্বল ইতিহাস এবং একাধিকবার এটি ধ্বংস ও পুনর্গঠনের প্রমাণ বহন করে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের হিসাব মতে, ট্রয় নগরী টিকে ছিল প্রায় ৪ হাজার বছর। খ্রিস্টপূর্ব ১৩শ সালে ট্রয় নগরী একবার ধ্বংস হয়েছিলো ভূমিকম্পের কারণে। এরপর শহরটি আরও ১শ বছর স্থায়ী হয় এবং আবারও সমৃদ্ধ রূপ ধারণ করে। ১১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটি আবার ধ্বংস হয়, এবারের কারণ ট্রোজান যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর ট্রয় নগরী আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
রোমান সম্রাট অগাস্টাসের রাজত্বকালে প্রাচীন ট্রয় নগরীর ধ্বংসস্তূপের উপর উইলিয়াম নামে নতুন একটি শহর নির্মিত হয়। কনস্টান্টিনোপল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইলিয়াম বিকশিত হয়েছে, কিন্তু বাইজান্টাইন রাজত্বের সময় ধীরে ধীরে এর পতন হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৭শ সালে এটি পুরোপুরি ভাবে পরিত্যক্ত হয়।
সুতরাং বেশিরভাগ প্রত্নতত্ত্ববিদ এ বিষয়ে একমত যে, ট্রোজান যুদ্ধ ট্রয় ধ্বংসের একমাত্র কারণ না হলেও, মূলত এই যুদ্ধের ফলেই সমৃদ্ধ এ শহরটি হারিয়ে যায় ইতিহাসের গহ্বরে।
তবে রূপকথার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে পারেন না প্রত্নতত্ত্ববিদরা। হোমারের কাব্যে বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্পার্টার রাজা ও হেলেনের স্বামী মেনিলাসের সঙ্গে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের দ্বৈত যুদ্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেনিলাস ও প্যারিসের মধ্যে লড়াইয়ে যে জিতবে সেই হেলেনকে পুরস্কার হিসেবে পাবে। কিন্তু একজন দেবতার হস্তক্ষেপে তাদের এ লড়াই থামাতে হয়। ফলে আবার ট্রোজান যুদ্ধ চলতে থাকে।
ইলিয়াডের একদম শেষ প্রান্তে এরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ আছে, যাতে গ্রিক বীর একিলিসের সঙ্গে ট্রোজান যোদ্ধা হেক্টরের লড়াই সংঘটিত হয়। হেক্টর জানতো, একিলিসের সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা তার পক্ষে সম্ভব না। তাই লড়াইয়ের একপর্যায়ে সে পালাতে শুরু করে। পেছন পেছন তাকে ধাওয়া করে একিলিস। হেক্টর দৌড়ে যখন ট্রয়ের দরজার কাছাকাছি তখন দেবতারা তাকে বাধা দেয়। ফলে একিলিসের হাতে মারা পড়ে হেক্টর।
হোমারের আরেকটি সৃষ্টি ওডিসিতে উঠে এসেছে ট্রোজান যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের কথা, যেখানে গ্রিক বীর ওডিসিয়াস যুদ্ধ শেষে নিজের বাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায়। সেখানে ‘ট্রোজান হর্স’ সম্পর্কে সম্পর্কে বিষদ বর্ণনা করা হয়। এই ট্রোজান হর্সই ছিল ট্রয় যুদ্ধে ট্রোজানদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
দশ বছরের চেষ্টার পরও যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পেরে গ্রিক যোদ্ধারা এক চাতুরির আশ্রয় নিলো। এই চাতুরির নামই হচ্ছে ট্রোজান হর্স। তারা সবার অজান্তে কালো রঙের বিশাল আকৃতির এক কাঠের ঘোড়া এনে ট্রয় নগরীর সম্মুখে রেখে গেলো। ট্রয়ের মানুষজন মনে করলো স্পার্টানরা যুদ্ধে হার মেনে নিয়েছে আর উপহার হিসেবে এই ঘোড়া রেখে গেছে। তারা কিছু না বুঝে ঘোড়াটিকে ট্রয় নগরীর ভেতরে নিয়ে আসে। আর এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
বিশাল এই ঘোড়ার ভিতর লুকিয়ে ছিল স্পার্টান সৈন্যরা। নগরবাসীর অসতর্ক মুহূর্তে তারা বের হয়ে আসে এবং শুরু করে হত্যাযজ্ঞ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইলিয়াড ও ওডিসিতে ইতিহাসের সঙ্গে কাল্পনিক বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণ ঘটায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে বেশিরভাগ মানুষই এই বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিলেন যে, ট্রয় নগরী বলতে আসলেই কিছু ছিলো। তবে তুরস্কের হিসারলিকে এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের পর মানুষ আবার নতুন করে ট্রয় ও ট্রোজান যুদ্ধের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে।
বাংলাদেশ সময়: ০১২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৭
এনএইচটি/এএ