ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

ওতেইয়ের নবজন্ম | কোইজুমি ইয়াকুমো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৬
ওতেইয়ের নবজন্ম | কোইজুমি ইয়াকুমো

[জনপ্রিয় জাপানি সাহিত্যিক প্যাট্রিক লাফক্যাডিও হিয়ার্ন (১৮৫০-১৯০৪) মূলত সাহিত্যমহলে পরিচিত ‘কোইজুমি ইয়াকুমো’ ছদ্মনামে। জাপান ও জাপানি রূপকথা, অতিপ্রাকৃত গল্প, কিংবদন্তী বিষয়ক রচনাগুলোর জন্যই তিনি দারুণ সমাদৃত।

গ্রিসের লাফকাডা দ্বীপে জন্ম নেওয়া এই লেখক পার করেছের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন। লাফকাডা দ্বীপে তার জন্ম হলেও,  গ্রিস-আয়ারল্যান্ড-জাপান ছিলো তার বিভিন্ন সময়ের নিবাসস্থল। সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও ক্রমশ তার লেখকসত্ত্বা বিকশিত হয়েছে দারুণ মহিমায়। শেষ জীবনে জাপান বিষয়ক নানা লেখার মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে অসামান্য স্বীকৃতি লাভ করেন। উনবিংশ শতকের শেষান্তে বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে জাপান অতোটা সুবিদিত ছিলো না। জাপান বিষয়ে তার লেখালেখি এসময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার জাপানি ছদ্মনামেই তিনি সমধিক পরিচিত। কোইজুমির বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ Kwaidan: Stories and Studies of Strange Things (1904) থেকে ‘The Story of O-Tei’ শিরোনামের গল্পটি অনুবাদ করেছেন শাকিলা পারভীন বীথি। ]


অনেককাল আগের কথা, ইচিঝেন প্রদেশের নিগিতা শহরে নাগাও চোসেই নামে এক লোক ছিলো।
    
নাগাওয়ের বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। নাগাও তার বাবার পেশাই বেছে নিতে ডাক্তারি পড়া শুরু করলো। খুব অল্প বয়সে তার বাবার এক বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়। মেয়েটির নাম ছিলো ওতেই। কথা ছিলো, নাগাও তার পড়া শেষ করেই বিয়ে করবে।

কিন্তু ওতেইয়ের দুর্বল স্বাস্থ্য তাদের বিয়েতে বড় বাধা হয়ে দেখা দিলো। পনের বছর বয়সে কঠিন রোগ হলো তার। যখন সে বুঝলো, মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই তার, সে চিরবিদায় নিতে নাগাওকে ডেকে পাঠালো।

নাগাও মুমূর্ষু ওতেইয়ের শয্যাপাশে এসে হাঁটুমুড়ে বসে পড়লো। ওতেই বললো, ‘প্রিয়  নাগাও, শৈশবকাল থেকেই আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম, হয়তো এ বছরের শেষে আমরা বিয়েও করতাম কিন্তু এখন আমি মৃত্যুর প্রহর গুনছি। কেবল সৃষ্টিকর্তা বলতে পারেন, কিসে আমাদের সবচেয়ে ভালো হবে। যদি আমি আরও কয়েক বছর বেঁচে থাকি, হয়তো সবার দুঃখের কারণ হবো। এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে আমি কখনই ভালো স্ত্রী হতে পারবো না। স্বার্থপরের মতো শুধু তোমাকে পাওয়ার আশায় বেঁচে থাকতে চাই না। মৃত্যুর কাছে আমি মাথা নত করেছি। তুমিও প্রতিজ্ঞা করো, তুমি দুঃখ করবে না। মনে রেখো, আমাদের আবার দেখা হবে। ’
‘নিশ্চয়ই, আমাদের আবার দেখা হবে’, নাগাও উত্তর দিলো। ‘সেই পবিত্রভূমিতে দেখা হবে আমাদের যেখানে বিচ্ছেদের বেদনা সহ্য করতে হয় না। ’
‘না! না!’ খুব মৃদুস্বরে নাকচ করে দিলো ওতেই, ‘আমি পবিত্রভূমির কথা বলিনি। আমি বিশ্বাস করি, নিয়তি এই পৃথিবীতেই আমাদের মিলিয়ে দেবে, যদিও আগামীকাল রচিত হবে আমার সমাধি’।  


নাগাও বিস্মিত হয়ে তাকালো ওতেইয়ের দিকে। অবাক হয়ে দেখলো, ওতেইয়ের ঠোঁটে খেলা করছে এক চিলতে হাসি। ওতেই তার ক্ষীণ স্বপ্নীল কণ্ঠে বলেই চলেছে, ‘হ্যাঁ, আমি এই দুনিয়ার  কথাই বলছি, তোমার এই জীবনের কথাই বলছি প্রিয় নাগাও। যদি তুমি চাও, আমাদের আবার মিলন হবে। আমাদের এ চাওয়া সত্যি করতে চাইলে আমাকে আবার জন্ম নিতে হবে, জীবনের নিয়মে পরিণত হতে হবে নারীতে। তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও পনের বা ষোল বছর। এটা দীর্ঘসময় নিশ্চয়, কিন্তু প্রিয় আমার, তোমার বয়সও তো সবে উনিশ’।


মৃত্যু পথযাত্রী বাগদত্তাকে সান্ত্বনা দিতে নাগাও বললো, ‘তোমার জন্য অপেক্ষা কখনই কর্তব্য নয় বরং আনন্দের চেয়েও ঢের বেশি। সাত জন্মের মিলনেও আমরা একে অপরের প্রতি এমনি প্রসন্ন থাকবো’।
নাগাওয়ের মুখের পানে চেয়ে ওতেই বললো, ‘তোমার কোনো সংশয় আছে’?
‘প্রিয়া, আমার সংশয় শুধু তোমাকে চিনতে পারা নিয়ে। এক ভিন্ন অবয়বে, ভিন্ন নামে কীভাবে চিনবো তোমায়, যদি কোনো সংকেত না দাও!’, বলে উঠলো নাগাও।
‘তা আমি পারবো না’, বললো ওতেই। ‘কেবল ঈশ্বরই জানে কখন আর কীভাবে আমাদের দেখা হবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, খুব, খুব নিশ্চিত- তুমি যদি আমাকে গ্রহণ করতে অসম্মত না হও, তবে অবশ্যই আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। আমার এই কথা তুমি ভুলে যেও না। ’
তার কথা থেমে গেলো, চোখ বুজে এলো তার। অবশেষে ওতেইয়ের পরপারে যাত্রার শেষঘণ্টা বাজালো মৃত্যু।
নাগাও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো ওতেইকে। বেদনার সাগরে নিমজ্জিত হলো সে। নাগাও তার নামখচিত শিলাপটটি রেখে দিলো গৃহকোণে রক্ষিত ওতেইয়ের স্মৃতি-সমাধিতে। প্রতিদিন সে এর সামনে বসে অর্ঘ্য দেয়।

মৃত্যুর আগে বলা ওতেইয়ের সেই অদ্ভুত কথাগুলো প্রায়শই ভাবনার ভেলায় ভাসিয়ে নিতো নাগাওকে। ওতেইয়ের আত্মা যেনো শান্তি পায়, এই ভেবে নাগাও একটি প্রতিজ্ঞাপত্র রচনা করে, যেখানে লেখা ছিলো, যে রূপেই ফিরে আসুক ওতেইকে বিয়ে সে করবেই। এই লিখিত প্রতিজ্ঞাপত্রটি তার নামের সিলমোহর দিয়ে মোহরাঙ্কিত করে সে। এরপর ওতেইয়ের সমাধির অন্তিম লিপিফলকের পাশে সেটি রেখে আসে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যেহেতু নাগাও ছিলো পরিবারের একমাত্র ছেলে, তাই বিয়ে করা তার জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো। সে খুব দ্রুত বুঝতে পারলো, তাকে পরিবারের জন্য অবশ্যই বিয়ে করতে হবে। বাবার পছন্দের নতুন কনে এলো তার ঘরে।
বিয়ের পরেও নাগাও কখনও ওতেইয়ের স্মৃতি সমাধিতে তার হৃদয়ের অর্ঘ্য দিতে বিরত থাকেনি। কোনোদিন ভুলে যায়নি সেইসব আবেগময় স্মৃতিচারণা। কিন্তু কে না জানে, সময় ধূসর করে দেয় স্মৃতির চিত্রপট! সত্য যা ছিলো, হয়ে যায় স্বপ্নসম- খুব সহজেই কি তাকে মনে করা যায়! সময়ের তাতে নেই কোনো দায়, সে ধাবমান আপন গতিতে অবিরাম।
ফুরিয়ে যাওয়া বছরগুলোতে কতো কতো দুর্ভাগ্য হানা দিয়েছে তার ঘরে! নাগাওয়ের বাবা মৃত- সেই পথেই গেছে তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান। অবশেষে সে দেখলো, এই চরাচরে তার আর কেউ নেই। সে ত্যাগ করলো তার নির্জন গৃহকোণ আর দুঃখ ভুলতে হলো নতুন পথের যাযাবর।


চলতে চলতে সে একদিন ইকাও নামে এক পাহাড়ি গ্রামে এসে পড়লো। সুশোভিত প্রকৃতি আর উষ্ণ বসন্তে মনোরম এই গ্রাম। নাগাও বিশ্রামের জন্য গ্রামটির সরাইখানায় ঢুকলো। তার ফরমায়েশ খাটতে একটি যুবতী মেয়েকে নিয়োজিত করা হলো। মেয়েটিকে দেখামাত্র নাগাওয়ের বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো, যেনো এমন করে কোনদিন তার বুক কেঁপে ওঠেনি। খুব অদ্ভুতভাবে মেয়েটিকে তার ঠিক যেনো ওচেই মনে হলো। নাগাও চিমটি কাটলো তার হাতে, হতেও তো পারে স্বপ্ন দেখছে সে। মেয়েটির চলাফেরা, আগুন জ্বালানো, খাবার আনা, ঘর গোছানোসহ সব কাজকর্ম ও ভাবভঙ্গিতে নাগাওয়ের কেবলই তার যুবা বয়সের বাগদত্তার কথা মনে পড়ছিলো, যার প্রেমে সুন্দর হয়ে উঠেছিলো তার অতীত জীবন।


অবশেষে মেয়েটির সঙ্গে তার কথা বলার সুযোগ মিললো। মেয়েটির প্রতিটি উত্তরে ফুটে উঠছিলো তার কণ্ঠের স্নিগ্ধতায় ভরপুর মাধুর্য যা নাগাওকে সেই বিশেষ দিনের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো বারবার।
পরম বিস্ময়ে সে মেয়েটিকে বললো, ‘ভগ্নি আমার, তুমি ঠিক আমার বহুদিনের চেনা এক মানুষীর মতো। আমাকে হতবাক করে দিয়েছে এই ঘরে তোমার প্রথম উপস্থিতি। ক্ষমা করে দিও, কেননা আমি জানতে চাই তোমার নাম ও জন্মস্থান’।

আকস্মিকভাবেই ওতেইয়ের আত্মা যেনো কথা বলে উঠলো, ‘আমি ওতেই আর তুমি ইচিঝেন শহরের নাগাও চোসেই, আমার  বাগদত্তা। সতেরো বছর আগে মৃত্যু হয়েছে আমার। তুমি লিখিতভাবে আমাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তুমি আমাকে বিয়ে করবে যদি আমি আবার তোমার পৃথিবীতে ফিরে আসি। তোমার সিলমোহরাঙ্কিত প্রতিজ্ঞাপত্র আমার সমাধিতে রেখেছিলে। তাই আমি আবার ফিরে এসেছি’। যেই না তার কথা শেষ হলো, মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।
নাগাও মেয়েটিকে বিয়ে করলো। তাদের দাম্পত্যজীবন সুখের হয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটি আর কখনও মনে করতে পারেনি, ওইদিন সরাইখানায় কী বলেছিলো সে। কিংবা তার কখনই মনে পড়েনি পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি। সুতরাং, যে স্মৃতির জানালা রহস্যজনকভাবে সেদিন খুলে গিয়েছিলো- তা আবার ধোঁয়াশায় পরিণত হলো। ধূসর স্মৃতির হাতছানি নিয়ে চলতে থাকলো নাগাওয়ের নতুন জীবন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৬
এসএনএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ