৩.
প্রায় ন’টা বাজে। খোকন দূর থেকে লক্ষ্য করে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীরা তখনও এসে পৌঁছায়নি।
খোকন চেষ্টা করে ইউনিভার্সিটির পিছনের গেট দিয়ে ঢুকতে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। সেখানেও ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ দাঁড়িয়ে, হাতে বন্দুক নিয়ে কড়া নজরে পাহাড়া দিচ্ছে। ততোক্ষণে ছাত্র-ছাত্রীরা দলবেঁধে মিছিল করতে করতে ইউনিভার্সিটির মেইন গেটের প্রাঙ্গণে চলে এসেছে। পুলিশ তক্ষুণি তাদের উপর হামলা চালায়, লাঠিচার্জ করে। কয়েকজনকে জামার কলার ধরে জবরদস্তি তুলে নেয় গাড়িতে। আর তখনই শুরু হয়ে যায় হট্টগোল, ভাগ-দৌড়, বিরূপ বিশৃঙ্খল পরিবেশ। খোকন চাদরের ভিতর থেকে এলোপাথাড়ি ছুড়তে লাগলো বারুদের গোলা। এরমধ্যে কয়েকজন ছাত্র কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেয় কয়েকটি পুলিশ ভ্যান। অন্যদিকে উত্তেজিত জনসমুদ্রের ঢেউয়ে ক্রমাগত ভেসে আসছে স্লোগানের তীব্র হুঙ্কার, জনগণের দাবি। তাদের অবরোধ করতে পুলিশ ছুঁড়তে থাকে কাঁদানে গ্যাস। তীরের মতো ছুড়ছে বন্দুকের গুলি। ক্রমান্বয়ে চলছে একটার পর একটা হৃদ-কাঁপানো বোমা-বারুদের বিস্ফোরণ। মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হয় এক বিভীষিকাময় রক্তাক্ত রণক্ষেত্র। রক্তে ভাসছে গোটা শহর, শহরের রাজপথ। চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আকাশে বাতাসে ভাসছে বারুদের উগ্র গন্ধ। চোখে পথ দেখা যাচ্ছে না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন- সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ভাইয়ের মতো আরও কতো অগুনতি বাংলা মায়ের বীর সন্তান, বীর যোদ্ধা। এ অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা দলভঙ্গ হয়ে যে যার আত্মরক্ষার্থে দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অন্ধের মতো ছুটতে শুরু করে।
এমনিতেই সকাল থেকে মন-মেজাজ ভালো ছিলো না মমতার। এর মধ্যে চতুর্দিক থেকে বজ্রপাতের মতো বোমাবাজির আওয়াজ কানে এসে লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি গায়ের উপর এসে পড়লো। সেই সঙ্গে মরার কাঁক একটা সেই তখন থেকে জানালার ধারে বসে তীব্র স্বরে কা কা করে ডাকছে। যেনো কোনো দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে। কোনো সংকেত দিতে চাইছে। কিন্তু মায়ের মন, সবসময় কু-ই গায়।
স্বাভাবিক কারণে হঠাৎ মনের মধ্যে উদয় হয়, কাকটি সত্যি সত্যিই কোনো দুঃসংবাদ বয়ে আনেনি তো! হে ভগবান, এমন বিপর্যয়ের মুখে খোকা কোথায় আছে! কী অবস্থায় আছে! ভেবে ভেবে কিছুতেই স্বস্তি পায় না মমতা। কতোসব কু-চিন্তা, কু-ভাবনা মনের মধ্যে এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। একদণ্ডও সুস্থির হয়ে থাকতে পারছে না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। খাঁচার পাখির মতো বারান্দার এমাথা-ওমাথা অনবরত পায়চারি করতে থাকে। কখনও রাস্তার দিকে গলা টেনে দ্যাখে।
একসময় থেমে যায় বোমা বারুদের বিস্ফোরণ, দাঙ্গা, হাঙ্গামা। কিন্তু রয়ে যায় তার রেশ। পড়ন্ত বেলায় ক্লান্তি সূর্য্য অস্তাচলে ঢলে পড়তেই গোটা পৃথিবীটা যেনো থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। চারদিকে থমথমে ভাব। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। রক্তে ভাসছে গোটা শহর। অন্যদিকে পুত্র বিয়োগের শোকে, দুঃখে কাতর কতো অভাগিনী মায়ের শূন্য বুক অশ্রুবন্যায় ভেসে যাচ্ছে। কিংবা স্বামী হারানোর শোকে বিহ্বলে মুহ্যমান হয়ে পড়ছে কতো নব পরিণীতা গৃহবধূ।
মনের অজান্তেই বুকটা হঠাৎ কেমন ছ্যাৎ করে উঠলো মমতার। হৃদস্পন্দন আরও দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। সারাশরীর কেঁপে ওঠে। ততোক্ষণে বিশাল জন-সমুদ্রের ঢেউ ওদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। সবুর সয় না মমতার। দ্রুত নেমে আসে আঙিনায়। চোখ পাকিয়ে দেখে, একদল যুবক ছেলে কাকে যেনো কাঁধে চেপে সাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওদের পিছন পিছন অগুনতি মানুষের ভিড়, ঠেলাঠেলি করছে সবাই।
এরমধ্যে ছুটে আসে অলকা। ছুটে আসে পাড়া-প্রতিবেশী, বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান সবাই। মুহূর্তেই ওদের বাড়ির চারিধারে ভিড় জমে ওঠে। যা ক্ষণপূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি মমতা। কিন্তু আপনগর্ভে লালিত সন্তান আর মায়ের নাড়ির চিরন্তন বন্ধন, সে এক অদৃশ্য শক্তি, এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, নাড়ির টান। তাকে অবরোধ করে সাধ্য কার! আর সেই অদৃশ্য বন্ধন শক্তির প্রভাবেই মমতাকে বারান্দা থেকে টেনে নিয়ে আসে প্রশ্বস্ত আঙ্গিনায় মাঝে। যার কারণ সে নিজেও জানতো না।
হঠাৎ আসে, উজ্জ্বলের নাম ধরে ছেলেরা কী যেনো বলছে। নিশ্চয়ই খোকনদের বাড়ি খুঁজছে। তবে কী খোকার কোনো অঘটন ঘটল?
ততোক্ষণে বুঝতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না মমতার। ভাবতেই বিদ্যুতের শকের মতো মায়ের অন্তরে খুব জোরে একটা ধাক্কা লাগে। থর থর করে হাত-পা কেঁপে ওঠে। বুক কেঁপে ওঠে। জমে যেন হিম হয়ে আসছে সারাশরীর। হঠাৎ ভেঙে পড়ে কান্নায়। অনুভব করে, পায়ের তলা থেকে মাটি যেনো ক্রমশ সরে যাচ্ছে। স্থির হয়ে আসছে চোখের দৃষ্টি। হারিয়ে ফেলছে নিয়ন্ত্রণ। একসময় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই ওকে জড়িয়ে ধরে অলকা।
ততোক্ষণে সাদা চাদরে ঢাকা খোকনের রক্তাক্ত মরদেহকে শুইয়ে রাখা হয় বারান্দায়। যেনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে উজ্জ্বল। জীবনের সব হিসেব-নিকেষ চুকিয়ে দিয়ে এসেছে। কতো নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে। কোনো চাহিদাই আর নেই। কারও প্রতি আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই, অভিযোগ নেই। কিন্তু ওর গর্ভধারিনী মা, মাকে কী জবাব দেবে খোকন? কেন মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে নীরবে চলে গেলো খোকন? এ কথার জবাব মমতা কি পাবে কোনোদিন? কেউ কি বোঝাতে পারবে কোনোদিন?
কারও মুখে কথা নেই। সবাই বাক্যাহত, বেদনাহত, মর্মাহত। বিমূঢ়-ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই। সবার চোখে জল। হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে একটি যুবক ছেলে এগিয়ে এসে বলে, ‘কই, উজ্জ্বলের মা কোথায়? তাকে ডাকুন’।
কিন্তু কোথায় উজ্জ্বলের মা? তখন ও’ আর ওর মধ্যে নেই। সম্পূর্ণ উন্মাদ। সমানে আবোল-তাবোল বকছে। কখনও আপনমনে বিড়বিড় করছে। কখনও চোখমুখের বিচিত্র অবয়বে নিজের মনের সঙ্গেই সমঝোতা করছে। বহু চেষ্টা করেও মমতাকে ঘরের ভিতরে নেওয়া গেলো না। বার বার শুধু বলছে, ‘আমার খোকাকে তোমরা কেউ দেখেছ? ও’ কোথায় গেছে তোমরা জানো? আমার খোকা এখনও বাড়ি ফিরে আসেনি। ওর খাবার গুছিয়ে রেখেছি। থালায় ঢাকা আছে। তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও না, চলে যাও না। আমি আছি এখানে। খোকা আমার ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এই সিঁড়িতেই বসে থাকবো’!
হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে দ্রুত এগিয়ে আসে অলকা। মমতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে কেঁদে ওঠে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ করে ওঠে। ‘আপনার খোকা আর ফিরে আসবে না মাসিমা। উজ্জ্বল আর ফিরে আসবে না। আমাদের মাঝে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। ভাষা আন্দোলনে জীবন বলিদান করে গেছে আমাদের উজ্জ্বল। অন্ধকার রাতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আমাদের সবার মাঝে উজ্জ্বল চিরদিন অমর হয়ে থাকবে মাসিমা। ওকে কোনদিন আমরা ভুলবো না। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৭
এসএনএস