তারপর কবি-কলিগ বলেন, “আরে ভাই! কবিতা তো পড়েন না, জানবেন কেমনে! এটা ইমতিয়াজ মাহমুদের বিখ্যাত কবিতা ‘যদি’ যেখানে এসব ঘটে। আর হারুন উনার সৃষ্ট চরিত্র।
পরে হারুন কবিতাটা পড়ে। এবং সে বুঝতে পারে না কবিতার কোথায় এই খিক খিক লুকিয়ে আছে! মানুষের অপমানে মানুষের কিসের এতো আনন্দ!
২.
তারপরেও বিধিবাম!
হারুন একদিন কথা নেই বার্তা নেই, হাল্কার উপর ঝাপসা পাক ধরা তেলতেলে চুল নিয়ে ঘরে ফিরে দেখলো সুন্দরী বউ বাথরুমে আর বউয়ের স্মার্ট ফোন আনলকড পড়ে আছে বিছানার উপর। টিং টিং টিং একটানা অনেকগুলো মেসেজ আসার সুরে নিজেকে অবশ্যম্ভাবী দমাতে না পেরে ফোনটা হাতে নিয়েই হারুন দেখলো মেসেঞ্জারে একজন অচেনা পুরুষ লাল হৃদয়ের বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছে অনবরত। এভাবে চুরি করে মেসেজ দেখে ফেলা ধরা পড়ে যাবে এই ভয়ে দ্রুত ঠিক যেখানে ফোন ছিলো সেখানেই রেখে দেয়। বউ বেরিয়ে এসে স্বাভাবিকভাবে চা বানিয়ে কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাচ্চা আর ফোন হাতে চলে যায় বারান্দায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে হারুন ভাবেন, বারান্দায় রেলিং না থাকলে ভালো হতো!
দুইদিন হারুন ঘুমাতে পারে না। হারুনের কেবলই ইচ্ছে হতে থাকে বউ আর তার প্রেমিকের কথোপকথন পড়তে। ঈর্ষা নয়, স্রেফ কৌতূহল! বউ কি সেই একই ভালবাসার টার্মগুলো ব্যবহার করছে যেমন করেছিল হারুনের সঙ্গে বিয়ের আগে যখন রাত জেগে ২৫ পয়সা মিনিটে কথা বলতো? যদি একই হয়, হারুনের খুব মন খারাপ হবে। না হলে কিছুটা স্বস্তি। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে হারুনের মনে পড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর কথা। যে বলেছিল, সে কখনও একই প্রেমালাপ দু’জন প্রেমিকের সঙ্গে করে না এবং যখনই সে বুঝে ফেলে কোনো প্রেমিকের স্টক খুব কম, আগের ডায়ালগ ঝাড়ছে, সে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় তাকে। বান্ধবী হাসতে হাসতে বলেছিল, “তোদের ছেলেদের এই এক সমস্যা। মিনাকে যা বলে পটাস, টিনাকেও তাই বলে পটাতে চাস। অথচ দ্যাখ মেয়েরা আচরণে ভিন্নতা রাখে। তুই এটাকে প্রতারণা বলতে পারিস। আমি বলি শিল্প”। হারুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, হয়তো তার বউও তার সঙ্গে যেভাবে প্রেম করেছিল, যেসব শব্দ ব্যবহার করেছিল তেমন করবে না। সেও হয়তো ভিন্ন একটা রূপ নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলে, যে রূপ হারুনের চেনা নয়। হারুনের খুব দেখতে ইচ্ছে হয় বউয়ের এই নতুন অচেনা রূপ। খুব লোভ হয় কীভাবে তারা পরস্পরকে প্রেম নিবেদন করে দেখতে। হারুন হাঁসফাঁস করতে করতে অপেক্ষা করতে থাকেন আবার মোবাইল আনলকড পড়ে থাকবে বিছানার উপর...
এই অপেক্ষার হাত ধরে হারুনের আত্মা শূন্যে ভেসে যায় এক মধ্যরাতে।
৩.
স্বর্গের প্রহরী হারুনের হাত থেকে কাগজপত্র নিয়ে চেক করে স্বর্গগত কবিদের সভায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে যায়। হারুন কাঁচুমাচু দাঁড়িয়ে থেকে বুঝে পায় না কী করবে! স্বর্গ হলেও সভাটা ঠিক যেনো যেমন ধারণা ছিলো দুনিয়াতে থাকতে তেমন নয়! রুমের মাঝ বরাবর রাখা একটা গোল টেবিলে চারজন তাস খেলছে। তাদেরকে ঘিরে অনেকেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে আছে। কেউ কেউ দলবেঁধে গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে দুনিয়ার কবিদের পিণ্ডি চটকাচ্ছেন। কেউ কেউ খুব ভাব নিয়ে ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন। কালো কিছু লোক গিটার বাজাচ্ছে আপনমনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। হারুন ঢুকতেই সব কোলাহল থেমে গেলো। সাধারণত কবি-শিল্পীদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী নরকে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঈশ্বর বলেছেন, সৃষ্টিশীল সব মানুষ মানে শিল্পী সে শব্দ নিয়ে বা রঙ নিয়ে মানুষের ভিতর অন্য একটা জগত তৈরি করতে পারে, তাদেরকে নরকে পাঠানো অন্যায় হবে। তো ঈশ্বরের এই মহানুভবতার কারণে কবি-সাহিত্যিকদের স্বর্গে একটা মোটামুটি মাথা গোঁজার ঠায় মিলেছে আর সেই সঙ্গে অল্প আরাম-আয়েশের আয়োজন জুটেছে যেমন স্বর্গে সবাই পেয়ে থাকে।
হারুনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক দাড়িওয়ালা সাদা চামড়া এসে জিজ্ঞেস করলো, “কোন দেশ?” হারুন বাংলাদেশ বলতেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো কোথায় যেতে হবে। হারুন এসে দাঁড়াতেই একজন ভুঁড়িওয়ালা হাত বাড়িয়ে বললেন, “কবি”?
হারুন ইতস্তত, “না”।
ভুঁড়িওয়ালা, “তাহলে এখানে কেন? এটাতো শুধুই কবিদের জন্য নির্ধারিত স্বর্গ”।
হারুন, “আমাকে এখানেই পাঠিয়েছে। এই দেখুন না কাগজ”।
ভুঁড়িওয়ালা পড়ে দেখলেন। লেখা আছে, “কবিতায় বিখ্যাত কোনো এক চরিত্রকে কবিদের স্বর্গে পাঠানোর আবেদনের প্রেক্ষিতে হারুনকে পাঠানো হলো! হারুন ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতার বিখ্যাত চরিত্র”।
ভুঁড়িওয়ালা হলি শিট বলে বাকিদের ডেকে বললেন, “দেখছ কাণ্ড! আমরা কী আবদার করেছিলাম। আর কাকে পাঠাইছে”!!!
চোখ কুতকুতে একজন বলে উঠলেন, “আমি তো ভেবেছিলাম নীরা বা হালের শিরিন এমন কাউকে পাঠাবে”।
ভুঁড়িওয়ালা রেগে গিয়ে যেনো তাকে ঠকানো হয়েছে এমন বিকৃত চেহারা করে বলে উঠলেন, “দাঁড়াও ঈশ্বরকে ফোন করি। ব্যাপারটা বোঝা দরকার”!
ভুঁড়িওয়ালা, “আশ্চর্য! বাংলা ভাষায় এতো এতো নারীকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে। সেসবের মধ্য থেকে আপনি কাউরেই পাইলেন না! পাইলেন এই গালভাঙা হারুনরে”!!!
অপরপ্রান্ত থেকে ঈশ্বর বললেন, “তোমাদের আবেদনের পর ইদানীং সবচেয়ে বেশি কবিতার কোন চরিত্র বিখ্যাত খোঁজ নিতে গিয়ে হারুনকেই পেলাম। আর তোমাদের যা চরিত্র ছিলো একেকজনের পৃথিবীতে থাকতে, তাতে মনে হলো নারী চরিত্রদের কাউকে পাঠালে তাকে নিয়ে তোমাদের কামড়াকামড়ি দেখতে দেখতে আমাকে আর স্বর্গে থাকা লাগবে না! আর তাছাড়াও পুরুষ কবিদের কবিতায় ইদানীং যেসব নারী চরিত্র দেখা যাচ্ছে তারা কেমন পুতুপুতু, অবাস্তব। তাই ভেবেচিন্তে হারুনকেই পাঠালাম”।
ধ্যাত্তেরি বলে ফোন রেখে দিয়ে ভুঁড়িওয়ালা চলে গেলেন। তার পিছু পিছু বাকিরাও। অবাঞ্ছিতের মতো হারুন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
৪.
ইমতিয়াজ মাহমুদ তখন অফিস শেষ করে ফেসবুকে পোস্ট “স্বর্গীয় হারুনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন” দিতে না দিতে পাঁচ মিনিটের মাথায় ২০টা হাহা, ৬টা ওয়াও, ১০টা ভালোবাসা, ৭টা দুঃখ এবং ৫২টা লাইক পড়ে গেলো।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
এসএনএস
ঘৃণার গল্প | মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
লাইক শেয়ার কমেন্ট | মাহবুব ময়ূখ রিশাদ
সেকেন্ডহ্যান্ড | মাহমুদ নোমান
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন | মাসউদ আহমাদ
গিলরয় | ফারাহ্ সাঈদ
ঘর | নুসরাত নীলা
প্রেম-অপ্রেমের কাব্য | নাহিদা নাহিদ
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম
বোবা সুখ | নাদিরা মুসতারী
খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্সান
যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
টান । আকাশ মামুন
এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে