রাথিন বাসায় এসেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে অফিসের কাজে। যে সময়টা একদিন মুমুর জন্য বরাদ্দ ছিলো।
রাথিন কি বদলে যাচ্ছে? কেন এমন করছে? কী এমন ব্যস্ততা? না কি মুমুকে এড়িয়ে চলছে। গত এক সপ্তাহে ন্যূনতম দায়িত্ববোধ লক্ষ্য করেনি রাথিনের মধ্যে। এভাবে কতোদিন মুখ বুজে থাকা যায়? মুমু আর পারে না। নিজের বাবা-মাকেও বলতে পারে না। ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিল তারা। এক বছরের ভালোবাসা যখন দাম্পত্য জীবনে পরিণত হলো, তখন কতোই না স্বপ্ন দেখেছে তারা। সেসব কথা ভাবতে গেলেও কেমন গুলিয়ে যায় সবকিছু। ভাবতে ভাবতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে মুমু।
প্রচণ্ড ক্ষোভ আর কষ্টে রুমের দরজা বন্ধ করেই শুয়ে পড়ে মুমু। রাথিন কাজ শেষে বেশ কয়েকবার দরজা নক করেও সাড়া না পেয়ে গেস্ট রুমেই শুয়ে পড়ে। ওদিকে মুমুর রাত কেটে যায় নির্ঘুম। রাতের খাবার টেবিলেই পড়ে থাকে। এদিকে কাজের চাপ আর মুমুর বাড়াবাড়ির ক্লান্তিতে সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে রাথিন। তেমন চিন্তা-ভাবনা আসে না মনে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হতেই পারে। সকালবেলা দিনের আলোয় মুখ দেখাদেখি হলেই ঠিক হয়ে যাবে।
রাথিনের অফিস সকাল এগারোটায়। তাই রাত দুটায় ঘুমোতে যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুক, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করেই সময় কাটে। অথচ এই সময়টুকুই একান্তভাবে চায় মুমু। রাথিন সেটা বুঝতেও পারে। কিন্তু কেন যেনো মনকে বোঝাতে পারে না। মুমুর আচরণগুলো তার কাছে ছেলেমানুষি মনে হয়। মুমুকে মাঝে মাঝেই বলে, ‘এখন ছেলেমানুষির বয়স নেই। অনেক তো হলো। এখন দায়িত্বশীল আচরণ করার সময়’।
মুমু সে কথা কোনোভাবেই মানতে রাজি নয়। ভালোবাসা কখনও বুড়ো হয় না। সবসময়ই তা সতেজ থাকে। ভালোবাসায় ছেলেমানুষি বলতে কিছু নেই। ভালোবাসা সারাজীবন শিশুর মতোই থাকে। ভালোবাসা বরাবরই সহজ-সরল, তুলতুলে, কোমল, অনুভূতিপ্রবণ। রাথিনের মনটা বুড়ো হয়ে গেছে বলে কটাক্ষ করে মুমু। রাথিন হাসে, চুপিসারে স্টাডি রুমে চলে যায়। অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে। মুমুকে কিছু আনার জন্য রান্নাঘরে পাঠায়। রাথিনের এমন উদাসীনতায় মুমু হতাশ হয়ে পড়ে।
সাত বছরের দাম্পত্য জীবনে এখনও ঘর আলো করে কোনো সন্তান আসেনি। বিয়ের পরে প্রথমে মুমুরই বারণ ছিলো। গর্ভধারণের অজানা ভয় ছিলো মনে। এখন আবার রাথিনের বারণ। ‘একটু গুছিয়ে নেই। বাড়ির কাজটা শেষ করি। নিজের ফ্লাটে উঠে সন্তান কামনা করবো’। ইত্যাদি বলে মুমুকে নিরস্ত করে। মুমুও সরল বিশ্বাসে স্বামীকে আশ্বস্ত করে যায়। হোক না তবে আগামী বছর। তবে সন্তানধারণ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই তাদের।
সকাল নয়টায় ঘুম ভাঙে রাথিনের। ঘুম ভাঙার পর ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আলস্য ভেঙে শোবার ঘরের দরজায় যায়। দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। ধক করে ওঠে রাথিনের বুক। সারা রাত কি দরজা খোলাই ছিলো? দরজা খুলে আরও অবাক হয়। খাটের দিকে চোখ পড়তেই মাথাটা ভনভন করে ওঠে। খাটে নেই মুমু। দ্রুত চলে আসে রান্নাঘরে। চুলাও জ্বলে না। আবার ছুটে আসে বাথরুমের দরজায়। দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। কেউ নেই।
চিন্তার জালে জড়িয়ে পড়ে রাথিন। সম্ভাব্য সবখানেই খুঁজেছে। কোথাও নেই মুমু। হঠাৎ ভেবেও পায় না। কোথায় যেতে পারে? ভাবতে ভাবতে আবার ঢোকে শোবার ঘরে। লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেয়। কর্নার টেবিলে অর্ধেক পানিভর্তি গ্লাসের নিচে একটা কাগজের টুকরো লক্ষ্য করে রাথিন। গ্লাসটা ডান হাতে তুলে কাগজটুকু বাম হাতে নেয়। ‘আমি চলে গেলাম। তোমার জীবনে জঞ্জাল হয়ে থাকতে চাই না। খুঁজো না আমায়’। লেখাটুকু পড়ে রাথিনের সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। এমন হবে ভাবতে পারেনি কখনও। মুমু কখনও তাকে না বলে কোথাও যায়নি। এমনকি বাবার বাসায়ও না। দৌড়ে মূল দরজার কাছে যায়। দরজা ভেজানো। ছিটকিনি বা লক নেই। তাহলে কখন বের হলো? কতো দূর গেলো? কোথায় গেলো? নানাবিধ জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকে।
এখন করণীয় কী? সাত বছরে এমন পরিস্থিতিতে কখনই পড়তে হয়নি। একটু আধটু রাগারাগি অনেক হয়েছে। এমন প্রতিক্রিয়া কখনই দেখতে পায়নি। এ কথা কার কাছে বলবে রাথিন? অফিসেরও সময় হয়ে যাচ্ছে। অফিসের বসকে ক্ষুদেবার্তা পাঠায়, ‘দুদিনের বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা-জ্বর এসেছে। অফিসে এলেও দেরি হতে পারে। অথবা না-ও আসতে পারি’। ফোনের ডায়াল কলে গিয়ে মুমুর নম্বর খোঁজে। সে কী? ডায়াল কলে মুমুর নম্বর খুঁজে পায় না রাথিন। বহুদিন কল করা হয়নি তাকে। তাই ডায়াল কলে মুমুর নম্বর নেই। রাথিন বুঝতে পারে, কতোটা দূরত্ব হলে ডায়াল কল থেকে ভালোবাসার নম্বর মুছে যেতে পারে।
কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে নম্বর বের করে কল করে রাথিন। প্রথম নম্বরটি বন্ধ। দ্বিতীয় নম্বরটি বের করে কল করে। সেটিও বন্ধ। কী করবে রাথিন? শ্বশুরের বাসায় ফোন করার সাহসও হয় না। তারা যদি কিছু না জানেন? তাহলে কার কাছে বলা যায়? কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এতো মধুর একটি সম্পর্ক তিলে তিলে এতো তিক্ত হয়ে উঠেছে রাথিন তা আগে উপলব্ধি করতে পারেনি।
কাউকে কিছু না বলেই অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকে সে। টেবিলে রাখা হাতঘড়িটা হাতে নিয়ে সময় দেখে। দশটা বেজে গেছে। এখন বের না হলে অফিসে যথাসময়ে পৌঁছানো যাবে না। যদিও বলা আছে, দেরি হতে পারে। তারপরও যথাসময়ে যাওয়ার জন্যই তড়িঘড়ি করে প্রস্তুতি নিতে থাকে রাথিন। যেহেতু নাস্তা করার অবকাশ নেই; সেহেতু গোসল সেরে জামা-প্যান্ট পরেই বের হয়ে যায় সে।
বাসা থেকে বের হয়ে বৃষ্টিস্নাত গলির জমানো হাঁটু পানি মাড়িয়ে মেইন রোডে যেতে বিশ মিনিট সময় শেষ। এরপর রাস্তার মোড় থেকে লোকাল বাসে উঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় রাথিনকে। ধাক্কাধাক্কি, গুতোগুতি অসহ্য লাগলেও দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে। সাড়ে দশটা। আশ্বস্ত হয় কিছুটা। তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে রাস্তা-জলে একাকার। দেখে মনে হয় না, রাস্তায় আছে সে। যেনো নৌযানে ভেসে ভেসে যাচ্ছে। তার ওপরে জ্যাম। মাথার ওপরে বৃষ্টি। থামার জো নেই। কষ্টে-সিষ্টে অফিসের সামনে নেমে তাকায় ঘড়ির দিকে। তখন পৌনে এগারোটা। হাফ ছেড়ে বাঁচে রাথিন। হোটেলে ঢুকে নাস্তা করে নেয়। সময় আছে দেখে খোলা দোকানে দাঁড়িয়ে লাল চা খেয়ে নেয়। চোখ যায় হাতঘড়িতে। সময় পৌনে এগারোটা। সময় যে থেমে আছে ঘড়িতে, তা আর খেয়ালই হয় না। রাথিন নিশ্চিন্ত মনে অফিসের লিফটে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। তাকিয়ে হতবাক। মানে কী? এগারোটা পাঁচ? দ্রুত হাতঘড়ির দিকে তাকায়। এখনও পৌনে এগারোটা। সেই কখন পৌনে এগারোটা দেখেই নাস্তা করতে গেলো।
অ্যাটেন্ডেন্সে ফিঙ্গার দিতে গিয়ে ভুলটা ভাঙে। ঘড়িটাই থেমে আছে। জীবনের মতোই থমকে গেছে তার হাতঘড়ি। থমকে আছে সময়। হ্যাঁ, সময়। সবই সময়ের কারসাজি। নতুন অফিসে চাকরির দু’মাস না যেতেই হাতঘড়িটা উপহার দিয়েছিলো মুমু। ‘এতো বড় কোম্পানিতে চাকরি হলো তোমার। হাতে একটা ঘড়ি না থাকলে কি মানায়?’ বলতে বলতে হাসিমুখে পরিয়ে দিয়েছিল। সেই ঘড়িটা মুমু বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলো? ভাবতে পারে না আর। রাথিন এবার সত্যিকারার্থে বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ভীষণ রকম বিষণ্নতা এসে ঘিরে ধরে তাকে।
অফিস শেষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে রাথিন। কোন দিকে যাবে? নিজের বাসায়? না কি মুমুদের বাসায়? মোবাইলটা হাতে নিয়ে শাশুড়ির নম্বরে ডায়াল করে। ‘হ্যালো, রাথিন। কেমন আছো বাবা? মুমুকে একা পাঠালে কেন? তুমি এসে দিয়ে যেতে পারতে। ’ বিষণ্ন বুক থেকে পাহাড় সমান বোঝা নেমে যায়। ‘সরি আম্মু, আমার খুব তাড়া ছিলো তো তাই। আমি এখন আসছি। মুমুকে নিয়েই বাসায় ফিরবো। ’
অফিস থেকে সোজা শ্বশুরের বাসা। দরজা খুলে দিলো কাজের মেয়েটা। শাশুড়ি এসে মুচকি হাসি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুমু তার রুমে সন্ধ্যার সাজগোছে ব্যস্ত। চেহারায় তীব্র অভিমান। চোখের কোণে জল। রাথিন ধীর পায়ে রুমে ঢুকে দু’বার গলা পরিষ্কার করে। মুমু ফিরেও তাকায় না। রাথিন চট করে বলে ফেলে, ‘মুমু জানো, তোমার দেওয়া হাতঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে’। মুমু আহত পাখির মতো ছিটকে উঠে রাথিনের সামনে দাঁড়ায়। রাথিনের বাম হাতটা চেপে ধরে ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। চোখে অভিমানের আগুন নিয়ে বলে, ‘কী? আবারও আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা?’ রাথিন অবাক হয়। ‘মিথ্যা? মানে কী? মিথ্যা বললাম কখন?’ ঘড়ি পরা হাতটা রাথিনের চোখের সামনে তুলে ধরে মুমু। ‘দেখ, ঘড়ির কাটা ঠিকই চলছে। আসলে থমকে গেছো তুমি। ’
রাথিন চূড়ান্তভাবে অবাক হয়। হতাশা ঘিরে ধরে তাকে। মনে মনে ভাবে, চললেও হয়তো টাইম ঠিক নেই। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় তো ঠিকই আছে। তাহলে ঘড়িটা আবার ঠিক হয়ে গেছে? বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের চোখকে। মুমুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে রাথিন। ‘তুমি চলে আসার পর থেকে আমার সময়ই হয়তো থেমে গিয়েছিল। তোমার কাছে এলেই দেখো সময় কেমন বহতা নদীর মতো দ্রুত চলে যায়। ’ মুমু এবার রাথিনের বুকে মাথা রেখে ভুলে যায় সব অভিমান। ভালোবাসার স্পর্শে গলে পড়ে পাথরবুকে।
রাথিন ভাবে, মুমু কাছে থাকলেই সময়কে কেমন সময় মনে হয়। না হলে সময় কেমন থমকে দাঁড়ায়। রাথিন বাম হাতটা তুলে মুমুর দেওয়া হাতঘড়িটায় একটা চুমু খায়। ‘আমার চেয়ে ঘড়িটাই বড়’ বলে অভিমান ঝাড়ে মুমু। ‘দাঁড়াও তোমাকেও দিচ্ছি। ’ বলে ঠোঁট বাড়ায় রাথিন। দরজা খোলা পেয়ে লাজুক পায়ে পালিয়ে যায় মুমু। রাথিনের চোখে তখন জল; আনন্দের কিংবা বেদনার। হয়তো মুমুকে পাওয়ার আনন্দ। নয়তো মুমুকে অবহেলার বেদনা। তার ছলছল চোখ দুটো অপলক তাকিয়ে থাকে হাতঘড়িটার দিকে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৭
এসএনএস /