ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

মোস্তফা কামালের প্রিয় পঞ্চাশ গল্প

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৬ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৯
মোস্তফা কামালের প্রিয় পঞ্চাশ গল্প প্রিয় পঞ্চাশ গল্পের প্রচ্ছদ ও মোস্তফা কামাল

পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে সত্তরের দশকের শেষার্ধে এসে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখের প্রিয় গল্পের সংকলন বেরোতে শুরু করল, বাংলাদেশেও পাঠকদের প্রত্যাশা সৃষ্টি হলো। প্রিয়, নির্বাচিত, বাছাই, সেরা—এ ধরনের ট্যাগ লাগানো গ্রন্থ প্রকাশে আমাদের কবিরা এগিয়ে—এটা মানতে হবে। আমাদের গল্পকার কেন পিছিয়ে থাকবেন? মোস্তফা কামাল পাঠকভাগ্যে আমাদের অনেকেরই ঈর্ষাভাজন। তাঁর পঞ্চাশতম জন্মজয়ন্তীতে একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশক তাঁকে দিয়ে বাছাই করিয়ে পঞ্চাশটি গল্পের একটি গর্ব করার মতো, সানন্দে দেখানোর মতো একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন: ‘প্রিয় পঞ্চাশ গল্প’। গ্রন্থটি দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ।

এখানে প্রিয় পঞ্চাশ গল্পের এ রকম একটি দ্বিতীয় প্রকাশনার কথা তাৎক্ষণিক মনে পড়ছে না; সম্ভবত আমাদের নেইও।

মোস্তফা কামালের নিয়মিত গদ্য লেখালেখির বয়স আটাশ বছর, প্রকাশিত গ্রন্থের সেঞ্চুরি আগেই হয়েছে।

 তাঁর বহুল পঠিত ‘জননী’ পশ্চিমের বড় প্রকাশনা সংস্থা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। হালে প্রকাশিত হয়েছে তিন উপন্যাসের অনুবাদ ‘থ্রি নভেলস’। কতগুলো গল্প থেকে পঞ্চাশটি বাছাই করার মতো পক্ষপাতদুষ্ট এই কাজটি লেখককে করতে হয়েছে আঁচ করা যাচ্ছে না। তাঁর প্রায় পনেরো বছর আগে শুরু করেও আমার মোট গল্পসংখ্যা সম্ভবত এখনো পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যায়নি। প্রিয় বাছাই করতে গেলে কয়টাকে রক্ষা করতে পারব, ভেবে আতঙ্কিত আছি। সদাহাস্য মোস্তফা কামাল সানন্দে এই কাজটি করতে পেরেছেন—অন্তত তাঁকে টু চিয়ার্স (ই এম ফর্স্টারের ‘টু চিয়ার্স ফর ডেমোক্রেসি’ থেকে দুই তালির ধারণাটি নিয়েছি) — প্রথম তালি অনেকগুলো গল্প লেখার জন্য, দ্বিতীয় তালি বাছাই করে পঞ্চাশটা টেকাতে পারার জন্য। তৃতীয় তালি পাঠকের জন্য সংরক্ষিত থাকল।

গল্পসংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ সেঞ্চুরির কাছাকাছি এসে ক্রিকেটের পরিভাষায় নার্ভাস নাইনটিতে আউট। এই আলোচনায় আমার ফোকাস লেখকের বিষয়বৈচিত্র্য।

পেশাগতভাবে সাংবাদিক হওয়ায় লেখক ক্ষমতা-কাঠামোর ভেতরটা এবং বাইরেরটা—দুই-ই পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি অনুসরণ করেছেন প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়নজীবীদের কথোপকথন। তাঁর সূচনা গল্প ‘আমলা কাহিনী’তেই মন্ত্রণালয়ের অধস্তন আমলা ইদ্রিস আলী যে অতি উত্তম মোসাহেব, তা পুরো অনুধাবন করার পরও মন্ত্রী সাহেব তাঁকে পছন্দ করেন, কারণ তিনি জানেন ‘তেল যেমন ইঞ্জিন সচল রাখে, মানুষও তেমনি প্রশংসা শুনলে তরতাজা হয়ে ওঠে। ’

ইদ্রিস আলী মন্ত্রীকে বললেন, ‘স্যার, আপনি এত অল্প সময়ে প্রধানমন্ত্রীর একেবারে কাছের মানুষ হয়ে যাবেন তা আমিও ভাবতে পারিনি। মন্ত্রণালয়ের কতগুলো প্রজেক্টের কাজ একসঙ্গে অনুমোদন করিয়ে আনলেন। এটা স্যার সবার পক্ষে সম্ভব না। এটাই আপনার বিশেষত্ব। ’

মন্ত্রী তাঁকে উপেক্ষা করতে পারতেন, ধমক দিয়ে সরিয়ে দিতে পারতেন, কিংবা প্রশংসা নীরবে হজম করে নিতে পারতেন। কিন্তু প্রশংসার চেয়ে বড় স্টিমুলেটর যে নেই। তার সেলফ স্টার্টার চালু হয়ে গেছে। তিনি না বলে থাকতে পারছেন না যে ‘আরে, এ তো কেবল শুরু! দেখেন আরো কী করি!’

মন্ত্রী সাহেব হাঁটছেন আর হাত কচলাচ্ছেন ইদ্রিস আলী। এটি নিত্যকার দৃশ্য। আরো চোখে লাগার মতো দৃশ্য আমি দেখেছি। দীর্ঘদেহী প্রতিমন্ত্রী ডায়রিয়ায় ভুগছেন এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বয়ং গ্লাস ভর্তি স্যালাইন নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করছেন আর বলছেন, স্যার, আর এক সিপ। নতুবা শরীরে ওয়াটার ইমব্যালান্স হয়ে যাবে।

মোস্তফা কামালের গল্পের মন্ত্রী ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে নেই। সোজাসাপটা বলে ফেললেন, ‘আমি ভাই গিভ অ্যান্ড টেকে বিশ্বাসী। দিয়ে থুয়ে খাই। বুঝতে পারছেন! জানেনই তো এখনকার যুগে নির্বাচন মানেই দশ কোটি টাকা খরচ। পার্টি ফান্ডে পাঁচ আর ভোটারসহ অন্যদের পেছনে পাঁচ। এ ছাড়া কেউ নির্বাচনে জিতে আসতে পারবে না। সম্ভবই না!...এই টাকা তুলতে হবে না। ’

অনুমান করা যায় গল্পটি বেশ আগে লেখা, এখন ইউপি চেয়ারম্যান হতে দশ কোটি খরচ হয়ে যায়। মন্ত্রীর সঙ্গে ইদ্রিস আলীর সখ্যে সচিবের গা জ্বলে যায়। ইদ্রিস জানেন সচিবও ম্যানেজেবল, দর কম আর বেশি।

ইদ্রিস যখন ঠিকাদারের কাছ থেকে পাওয়া টাকাভর্তি ব্রিফকেস মন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন এবং মন্ত্রীকে সতর্ক করে দেন তাঁর এপিএস যেন কিছুই না জানে। এরা মানুষ ভালো না, যে পাতে খায় সে পাতে হাগে। ’ মন্ত্রী তখনই বলে ওঠেন, ‘আমার আর একজন ক্যাবিনেট কলিগকে তার এপিএস যেভাবে ফাঁসিয়েছে!’

ফোকাস বদলায়, ভোরবেলায় আলোকসম্পাত হয় সচিবের বাড়িতে, ইদ্রিস আলী ঠিকাদারের গিফট একটা নতুন গাড়ি নিয়ে এসেছেন সচিবের বাড়িতে, গাড়িটা সচিবের জন্য।

গল্পকার দুর্নীতির যে চক্রটি রচনা করেছেন তা বাস্তবতা থেকেই তুলে আনা। শেষ পর্যন্ত ‘আমলা কাহিনী’ নগরজীবন, রাজনীতি, ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শোষণের একটি নকশা।

‘কাবুল উপাখ্যান’ গল্পে লেখক স্বদেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসু চরিত্র আরশাদকে পাঠাচ্ছেন আফগানিস্তানে তালেবান অধ্যুষিত দেশটির নিউজ কাভার করতে। এয়ারপোর্টে অবতরণের পরপরই যে আরশাদ তালেবান মুঠিতে চলে গেল তা বুঝল এক হাজার ডলার মুক্তিপণ দিয়ে নিজেকে উদ্ধার করার পর।

লেখক একসময় স্পষ্ট করে দিলেন সাংবাদিক কিডন্যাপ করার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব। গল্প থেকে খানিক উদ্ধৃতি :
: সাংবাদিকের এত ডিমান্ডের কারণ?
: আপনাদের কিডন্যাপ করলে হিউজ টাকা পাওয়া যায়। হার্ড ক্যাশ। তালেবানরা আপনাদের মতো লোকদের খোঁজে।
: সাংবাদিকদের কিডন্যাপ করে ওদের লাভ?
: ইন্টারন্যাশনাল নিউজ হবে। সারা বিশ্ব আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাবে। এখনো তালেবানরা যে সক্রিয় সে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

‘একজন রাজনীতিকের ইতিকথা’ এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না। এই কাহিনির মোফাজ্জল হোসেন পুরোপুরি একালের চরিত্র। তিনি কোনো এক স্বৈরাচারী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু সরকারের পায়ের তলার মাটি যখন দ্রুত সরে যাচ্ছিল সুনামি আঁচ করতে পারা বুনো হাতি কিংবা পিপীলিকার মতো নিবাস ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এলেন, ছেদ ঘটালেন সম্পর্কের। স্বৈরাচারের পতন ঘটলে সরকার গঠন করলেন। মোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী একদা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা তাহমিনা সবিস্ময়ে দেখলেন তাঁর স্বামীকে ব্যান্ড বাজিয়ে অভিবাদন জানাতে দলে দলে মানুষ আসছে, কারণ তিনি আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। পরিচিত চরিত্র যখন গল্পে উঠে আসে, পাঠকের কৌতূহল এমনিই বেড়ে যায়।

‘নলিনীকান্ত বাবুর শেষ বাড়িটা’ সাতক্ষীরার ক্ষয়িষ্ণু জমিদারদের একজন নলিনীবাবু রাখতে পারলেন না। প্রতিহিংসার আগুন বাড়িটাকে ভস্মীভূত করল—তাঁর হয়ে তাঁর বন্ধু প্রভাবশালী সাফদার অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দিলেন, নলিনীবাবুর ছেলে নিশিকান্ত মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তাহীন জীবন থেকে সরিয়ে নেবে। শান্তির লোভে চাপের মুখে দুই বন্ধু যখন মামলা প্রত্যাহার করে আদালত থেকে বের হলেন, ঘাতক তাঁদের দুজনকেই হত্যা করল। কাহিনিটি স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির লড়াই।

‘একাত্তরের চিঠি’ গল্পে বাবা ছেলেকে তার মায়ের সামনে হাজির করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুমতি তার চাই। এ তো বায়স্কোপ দেখতে যাওয়ার অনুমতি নয়। কিন্তু মা যখন জানলেন তাঁর স্বামীও একই সঙ্গে যুদ্ধে যাচ্ছেন, তিনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন: কিন্তু আপনি যাবেন সেটা তো আমাকে বলেননি!

বাবা ও ছেলে তখন যুদ্ধে—একটার পর একটা সাফল্য আসছে। রাতে একটি বড় অপারেশন! তার আগেই ছেলে মায়ের জন্য একটি আবেগময় চিঠি লিখে কালই পোস্ট করবে।
কিন্তু রাতের সেই অপারেশন ছেলেকে রেহাই দেয়নি। রক্তভেজা চিঠি শুকায়, ছেলের সহযোদ্ধা সংরক্ষিত চিঠি যখন মাকে দিতে আসে, তিনিও তখন নিরুদ্দেশ।

পঞ্চাশটি গল্পের অর্ধেক গল্প কোথাও না কোথাও বাংলাদেশের ইতিহাসকে ছুঁয়ে গেছে, কখনো ইতিহাস ধারণও করেছে।

প্রেম, যন্ত্রণা, মাতৃত্ব, নিরুদ্দেশ জীবন, অভিমান, সুখ, দ্বন্দ্ব, সংসার সৃষ্টি ও ভাঙন, নিত্যকার জীবনসংগ্রাম—বহু বিষয় গল্পে উঠে এসেছে। উঠে এসেছে তাঁর নিজ গ্রাম আন্ধারমানিকও।

শেষ গল্প ‘শেখ মুজিব, মোনেম খাঁ ও জেনারেলগণ’ পড়ার সময় এটা গল্প মনে হয়নি, মনে হয়েছে উপন্যাসের মাঝখানের একটি অধ্যায়—প্রশ্ন জাগতেই পারে, তার আগে কী? তার পরে কী?

‘জেলখানার ছোট্ট রুমে শুয়ে আছেন শেখ মুজিব। তাঁর ঘুম আসছে না। তিনি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন। বড় ধরনের দুশ্চিন্তা তাঁর মাথায় ভর করছে। হঠাৎ এমন লাগছে কেন, তা-ও তিনি বুঝতে পারছেন না। তাঁর পাশের বেডে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিন অ্যাডভোকেট নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। ১৭ মাস একাকী থাকার পর তাঁর রুমে আবদুল মোমিনকে আনা হয়। ’

ডেপুটি জেলর সুখবর দেন, শেখ মুজিব মুক্তি পাচ্ছেন। কথিত মুক্তির মুহূর্তেই আবার গ্রেপ্তার হন। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। সে অধ্যায়ের নাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।

প্রকাশককে সাধুবাদ। লেখককে ধন্যবাদ তিনি বইটি তাঁর মমতাময়ী মাকে উৎসর্গ করেছেন। ৩০ মে পঞ্চাশ বছরে পা রাখছেন লেখক। তার জন্মস্মরণে পাঠকের নিরন্তর শ্রদ্ধা, অশেষ ভালোবাসা।

প্রিয় পঞ্চাশ গল্প: মোস্তফা কামাল | প্রকাশক: অনন্যা | প্রথম প্রকাশ: মে ২০১৯, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ | মূল্য: ৬০০ টাকা |

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৯
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ