ঢাকা: বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের বড় একটি অংশ আর্জেন্টিনার সমর্থক। বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই এদেশে যে উন্মাদনা দেখা যায় তার প্রায় সবটা জুড়েই থাকে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল শিবির।
প্রতি চার বছর পরপর বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী আর্জেন্টিনার বিপুলসংখ্যক ভক্ত-সমর্থক প্রার্থনা করেন তৃতীয় শিরোপার। অথচ গত ২৮ বছর ধরে তা অধরাই রয়ে গেছে ম্যারাডোনার অনুজদের।
২০তম বিশ্বকাপের চতুর্থ দিনে বাংলাদেশ সময় সোমবার ভোর ৪টায় শুরু হচ্ছে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ মিশন। এদিন বসনিয়া-হার্জেগোভিনার বিপক্ষে তৃতীয় শিরোপা জয়ে শুভযাত্রা শুরু হবে মেসিদের।
অমরত্বের হাতছানি মেসির সামনে
বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ক্ষুদে যাদুকর যে যাদু দেখিয়ে যাচ্ছেন। বার্সেলোনার শোকেস ও তার নিজের শোকেসে যতগুলো ট্রফি এনে রেখেছেন, একজন ফুটবলারকে অমরত্ব দিতে এর অর্ধেকই যথেষ্ট।
তবু সর্বকালের সেরা ফুটবলার হতে মেসির চাই এখন একটামাত্র ট্রফি। এবার অমরত্ব পেতে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিততে মেসি এসেছেন আটঘাট বেঁধে।
আর্জেন্টিনা ও বার্সা সতীর্থ থেকে শুরু করে ফুটবলের অনেক রথী-মহারথীর ধারণা এবার মেসি পারবেন আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিতে। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আর্জেন্টাইনরা যে অতৃপ্তি বয়ে বেড়াচ্ছেন, মেসির পায়েই হবে তার অবসান।
এরইমধ্যে ২৬ বছর বয়সী এই মহাতারকা জিতেছেন ছয়টি লা লীগা, তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এবং দুটি কোপা ডেল রে সহ অসংখ্য শিরোপা ও সম্মাননা। ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে জিতেছেন টানা চারবার ফিফা ব্যালন ডি’অর ট্রফি।
মেসির বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি বার্সার জার্সি গায়ে যতটা উজ্জ্বল, আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ততটাই অনুজ্জ্বল। তবে তার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলা সমালোচকদের মুখও বন্ধ করে দিয়েছে। বাতিগোল খ্যাত বাতিস্তুতাকে টপকে মেসি এখন আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা।
ববাবর শান্ত মেসি মুন্সিয়ানা দেখিয়েই চারদিক থেকে ধেয়ে আসা তীরের জবাব দেবেন এমন বিশ্বাস তার সতীর্থ ভালদানোর।
ক্লাব-সাফল্যের বিচারে অতীত-বর্তমানের সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া মেসির অমরত্বের জন্য দরকার একটা বিশ্বকাপ। কিন্তু দুই বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে তার গোলসংখ্যা মাত্র একটি!
এসবের প্রায়শ্চিত্তের পাশাপাশি সব হিসেব-নিকেশ শেষ করে শিরোপা জিতে দেশে ফিরবেন এমন প্রত্যয় নিয়েই ব্রাজিল এসেছেন মেসি। আর্জেন্টিনার কোটি সমর্থক সেই মাহেন্দ্রক্ষণের আশায় রয়েছেন। আর্জেন্টিনাবাসীর কাছে যুবরাজ মেসি কেবল একটি ট্রফি দিয়েই পারেন ম্যারাডোনার থেকে সম্রাটের সিংহাসন নিতে। সেইসঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বের সেরা ফুটবলারের মর্যাদা পেতে।
অতীতের গৌরবগাঁথা
শেষবার দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ সালে। সেবার ম্যারাডোনার একক নৈপূণ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দলটি।
এর আগে ১৯৭৮ সালে স্বাগতিক হিসেবে প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। সেবার ফাইনালে হল্যান্ডকে হারায় তারা। সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতা হন আর্জেন্টিনার মারিও কেম্পেস।
এরপর আসে আর্জেন্টিনার ফুটবলের স্বর্ণযুগ। সে সময়ের অন্যতম সেরা তারকা ম্যারাডোনার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।
ওই বিশ্বকাপেই ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ম্যাচ ম্যারাডোনাকে এনে দেয় অমরত্ব। গোলশূন্য প্রথমার্ধ শেষে দ্বিতীয়ার্ধের ছয় মিনিটে ম্যারাডোনা হাত দিয়ে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। যা পরবর্তীতে ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে পরিচিত হয়। এর ঠিক চার মিনিট পর মিডফিল্ডের পাঁচ ইংরেজ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে এবং গোলরক্ষকে বোকা বানিয়ে দ্বিতীয় গোল করেন ম্যারাডোনা। যা শতাব্দীর সেরা গোলের মর্যাদা লাভ করে।
পরে ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে জয়লাভ করে ম্যারাডোনার দল। পাঁচ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন নেপোলির মহানায়ক।
শিরোপা বন্ধ্যাত্বের শুরু
এরপর ১৯৯০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা দলকে ফাইনালে নিলেও জেতাতে পারেননি। এরপর আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ ১৪৫ ম্যাচ খেলা হাভিয়ের জানেত্তি, ১১৫ ম্যাচ খেলা রবার্তো আয়ালা, ৮৭ ম্যাচে ১৭ গোল করা আরিয়েল ওর্তেগা, ৭৮ ম্যাচে ৫৬ গোল করা আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা বাতিগোল খ্যাত গাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হার্নান ক্রেসপো, হুয়ান পাবলো সোরিন, আয়মার, নুতন ম্যারাডোনা খ্যাত ভেরন, রিকুয়েলমে কিংবা এল অ্যাপাচি খ্যাত তেভেজরা প্রবল প্রতাপে ফুটবল বিশ্ব শাসন করলেও বিশ্বকাপ মঞ্চে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
এমনকি ব্যর্থ হয়েছেন এ গ্রহের বর্তমান সময়ের ও সর্বকালের অন্যতমে সেরা ফুটবলার লিউনেল মেসি। এর আগে ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপে অংশ নিলেও তিনি ছিলেই বয়সে তরুণ ও অনভিজ্ঞ।
সেরা আক্রমণভাগ ও সম্ভাবনা:
এবার ব্রাজিল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার নেতৃত্বভার মেসির কাঁধে। তিনি এখন পরিণত ও অনেক বেশি আগ্রাসী। গোটা ফুটবল জগত ও বোদ্ধারা এবার মানছেন মেসির হাতেই উঠতে পারে এবারের শিরোপা। দূর হবে আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের বন্ধ্যাত্ব।
২৮ বছরের শিরোপা খরা দূর করতে এবার আর্জেটিনাই অন্যতম ফেভারিট দল। মেসিদের কোচ আলেসান্দ্রো সাবেলার হাতে রয়েছে টানা চারবারের ফিফা ব্যালন ডি’অর বিজয়ী বার্সেলোনা নিউক্লিয়াস মেসি, নেপোলি স্ট্রাইকার হিগুয়েন, বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ম্যানসিটি তারকা আগুয়েরো এবং এ বছর রিয়াল মাদ্রিদের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের অন্যতম কারিগর ডি মারিয়া।
এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এমনকি যার মতো ফুটবলারকে পেতে পেতে অনেক কোচই হা-পিত্যেশ করছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা সেই কার্লোস তেভেজকে বাদ দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি কোচ সাবেলাকে।
আশার বেসাতি
১৯০১ সালে জাতীয় দল গঠনের পর ওই বছরের ১৬ মে প্রথম ম্যাচেই উরুগুয়েকে ৩-২ গোলে হারিয়ে ফুটবলে যাত্রা শুরু আর্জেন্টিনাকে তৃতীয় শিরোপা খরা চলছে ২৮ বছর ধরে। হয়তো এটা বিধাতারই অঙ্গুলি হেলন।
আর্জেন্টিনা ফুটবলের মহাতারকা বাতিস্ততা, ওর্তেগা, ক্রেসপো, ভেরন, রিকুয়েলমে, তেভেজ এমনকি হালের মারিয়া, হিগুয়েন, আগুয়েরো ও মেসিরা বিশ্বের নামী-দামী ক্লাবগুলোর শোকেস ভর্তি করে ফেলেছে সম্ভাব্য সব ট্রফিতে। অথচ তৃতীয় শিরোপার জন্য তাদের অপেক্ষা ২৮ বছরের! একে ইশ্বরের হেয়ালী ছাড়া কিইবা বলা যায়?
হয়ত ম্যারাডোনার পর মেসি নামক এক ক্ষুদে যাদুকরের পা দিয়েই ফুটবল ইশ্বর এক অমর ইতিহাস লেখাবেন বলেই এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা। ১৩ জুলাই মারকানায় মেসি ট্রফি উচিয়ে ধরবেন বলেই এত নাট্যায়োজন।
ওইদিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারের জায়গায় লেখা হবে মেসির নাম। তার হাতে বন্ধ্যাত্ব ঘুচবে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শিরোপার। এসব মঞ্চায়নের জন্যই এবারের ব্রাজিলে মহাআয়োজন। এমন বিশ্বাস বুক বেঁধে আছেন আকাশী-নীল অন্তপ্রাণরা।
খেলার সূচি:
অপেক্ষা পূরণের এ মিশনে ১৫ জুন মেসি বাহিনীর প্রথম খেলা বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সঙ্গে। পরের দুই ম্যাচ ২১ জুন রাত ১০টায় ইরান ও ২৫ জুন রাত ১০টায় নাইজেরিয়ার সঙ্গে।
আর্জেন্টিনা স্কোয়াড:
গোলরক্ষক: মারিয়ানো আন্দুহার (কাতানিয়া), স্যার্জিও রোমেরো (মোনাকো), অগাস্টিন ওরিয়ন (বোকা জুনিয়রস)।
ডিফেন্ডার: লিসান্দ্রো লোপেস (গেটাফে), উগো কাম্পানিয়ারো (ইন্টার মিলান), ফেদেরিকো ফার্নান্দেস (নেপোলি), পাবলো সাবালেতা (ম্যানচেস্টার সিটি), এসেকিয়েল গারায় (বেনফিকা), মার্কোস রোহো (স্পোর্টিং লিসবন), হোসে বাসান্তা (মন্তেরেই), নিকোলাস ওতামেন্দি (অ্যাথলেটিকো মিনেইরো), মার্টিন দেমিচেলিস (ম্যানচেস্টার সিটি), গ্যাব্রিয়েল মেসার্দো (রিভার প্লেট)।
মিডফিল্ডার: হ্যাভিয়ার মাসচেরানো (বার্সেলোনা), হোসে সোসা (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), আউগুস্তো ফের্নান্দেস (সেল্টা ভিগো), রিকি আলভারেস (ইন্টার মিলান), লুকাস বিগলিয়া (লাতসিও), এভার বানেগা (নিওয়েলস ওল্ড বয়েস), ফার্নান্দো গাগো (বোকা জুনিয়রস), ম্যাক্সি রদ্রিগেস (নিওয়েলস ওল্ড বয়েস), এনসো পেরেস (বেনফিকা), ফাবিয়ান রিনাওদো (কাতানিয়া)।
ফরোয়ার্ড: লিওনেল মেসি (বার্সেলোনা), অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (রিয়াল মাদ্রিদ), রদ্রিগো পালাসিও (ইন্টার মিলান), গঞ্জলো হিগুয়েন (নেপোলি), স্যার্জিও আগুয়েরো (ম্যানচেস্টার সিটি), এসেকিয়েল লাভেসিস (পিএসজি) ও ফ্রাঙ্কো ডি সান্তো (ভার্ডার ব্রেমেন)।
** বিশ্বকাপের ফোর মাস্কেটিয়ার্স
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪