ইকার্দির বর্তমান ফর্মের কারণে তাকে দলে টানতে উন্মুখ ইউরোপের বড় বড় ক্লাব। বিশেষ করে ইংলিশ ক্লাব চেলসি তো প্রায় উঠেপড়েই লেগেছে।
এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। ইকার্দিকে দলে না রাখা নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি। তবে এর কারণ অনুসন্ধানে ব্লিচার রিপোর্ট চালিয়েছে অনুসন্ধান। তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইকার্দির অনেক অজানা অধ্যায়।
আর্জেন্টিনার ক্লারিন পত্রিকার এক সাংবাদিক বুস্তোস মিল্লা বলেছেন, ইতালিয়ান ফুটবলের সেরা গোলদাতাকে দলে না রাখাটা অনেক বেদনাদায়ক। ইকার্দির বিষয়টা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বিগত কয়েক বছর ধরেই আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এই প্রশ্ন তুলেছে যে, এমন অসাধারণ ফুটবলরত্নকে কেন দলে নেওয়া হচ্ছে না? শুধু সাম্পাওলি নন, এর আগে আলেসান্দ্রো সাবেলা, টাটা মার্টিনো ও এদোয়ার্দো বাউজার দলেও জায়গা হয়নি তার।
হোর্হে সাম্পাওলি বিশ্বকাপ উপলক্ষে ৩৫ জনের প্রাথমিক দলে রেখেছিলেন ইকার্দিকে। আর্জেন্টাইন কোচের ঘোষিত স্কোয়াডে এমনিতেই সেন্টার ফরোয়ার্ডের অভাব নেই। ম্যানচেস্টার সিটির সার্জিও অ্যাগুয়েরো, জুভেন্টাসের গঞ্জালো হিগুয়েন এই দুজনকেই মূলত ইকার্দির স্থানে বিবেচনা করেছেন সাম্পাওলি। তরুণ ইকার্দির চেয়ে অভিজ্ঞ দুই স্ট্রাইকারের ওপরই ভরসা রেখেছেন সাম্পাওলি।
গতববছর ভেনেজুয়েলা ও উরুগুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে একাদশে ইকার্দিকে রেখেছিলেন আর্জেন্টাইন কোচ। তবে দুই ম্যাচেই গোল করতে ব্যর্থ হন তিনি। আর্জেন্টিনার লা নেসিয়ন পত্রিকার সাংবাদিক পাবলো লিসত্তো বলেন, হিগুয়েনের গোল করার রেকর্ড নিয়ে অখুশি ছিল সমর্থকরা। তারপর ইকার্দি দুলে সুযোগ পেলেন। কিন্তু যে কয় ম্যাচে তিনি সুযোগ পেয়েছেন গোল করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে এ পর্যন্ত পড়ে যারা ভাবছেন কারণ তাহলে এই, তাদের জন্য চমক অপেক্ষা করছে। কারণ, উপরে উল্লেখিত কারণগুলো সবাই কমবেশি জানেন। কিন্তু ফুটবল বহির্ভূত কারণও এতে জড়িত।
ইতালিভিত্তিক পত্রিকা ফোর্জা ইতালিয়ান ফুটবলের সম্পাদক ডেভিড স্কিয়াভোনে বলেন, ‘মাত্র ২২ বছর বয়সেই ইন্টার মিলানের অধিনায়ক হন ইকার্দি। এটা দিয়েই বুঝা যায় ওই বয়সেই তার ওপর এত বড় দায়িত্ব দেয়ার পিছনে ইন্টারের ভাবনা কী ছিল। সে সমর্থকদের টার্গেট হতে পছন্দ করে। সে এমন একজন যাকে প্রতিপক্ষের সমর্থকরাও টার্গেট করে। ইন্টারের চরমপন্থি সমর্থকদের সাথে এর আগে কয়েকবার ঝগড়ায় জড়াতেও দেখা গেছে তাকে। সে মানুষের সাথে বিবাদে জড়াতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
এটা খুব আশ্চর্যজনক বিষয় যে, যে ক্লাবের দীর্ঘদিনের অধিনায়ক তিনি সেই ক্লাবের সমর্থকদের কাছেই অজনপ্রিয় ইকার্দি। ২০১৬ সালে ক্যালিয়ারির বিপক্ষে এক ম্যাচে তিনি পেনাল্টি মিস করায় ইন্টারের সমর্থকরাই উল্লাস প্রকাশ করেন। ২০১৫ সালে একবার ৩-১ গোলে হেরে যাওয়া এক ম্যাচ শেষে এক কিশোর সমর্থককে নিজের জার্সি উপহার দিতে গেলে এক উগ্র সমর্থক তা তার দিকেই ছুড়ে মারেন।
এখানেই শেষ নয়। নিজের আত্মজীবনীতে ইকার্দি নিজেই লিখেছেন যে, একবার ইতালিতে তার বাসস্থানে ইন্টারের কিছু উগ্র সমর্থক হামলা চালায়। ক্লাবের কর্মকর্তারা তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু তার নিজের মত কী ছিল জানেন? তার মতে, ‘তারা (হামলাকারী) কতজন ছিল? ৫০/১০০/২০০? ঠিক আছে, আমার মেসেজ রেকর্ড করে রাখুন। আমি আর্জেন্টিনা থেকে ১০০ সন্ত্রাসী আনবো যারা ওদের জায়গায় মেরে ফেলে আসবে। ’ তার এমন আচরণের কারণে তাকে ‘ভাঁড়’ নামে অভিহিত করেছিলো ইন্টারের সমর্থকরা।
ইকার্দির প্রেমজীবন এককথায় সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। তিনি বিয়ে করেছেন যে নারীকে সেই নারী আর কেউ নন, আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় ম্যাক্সি লোপেজের সাবেক স্ত্রী ওয়ান্দা নারা। যিনি আর্জেন্টিনার টেলিভিশন সেলিব্রেটি। এই ওয়ান্দার নারার সাথে ২০১৩ সালের নভেম্বরে পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি ঘটান লোপেজ। এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পরেই টুইটারে বেশকিছু মেসেজ বিনিময় করেন ইকার্দি-ওয়ান্দা। সেই মেসেজে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তারা। সেখানে তারা আর্জেন্টিনায় ২৪ ঘণ্টায় ১৫ বার ‘ম্যারাথন যৌন মিলনের’ কথা প্রকাশ করেন।
২০১৪ সালে ইকার্দি-ওয়ান্দা বিয়ে করেন। নিজের আত্মজীবনিতে ইকার্দি দাবি করেছেন, লোপেজের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা অবস্থায়ই ওয়ান্দা তার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করেন। এর মধ্যে নাকি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে একবার বড় এক ইয়টে করে সমুদ্রভ্রমণের জন্য আরেক আর্জেন্টাইন ফুটবলার গঞ্জালো বার্গেসিওর সাথে ইকার্দিকেও আমন্ত্রণ জানান ওয়ান্দা।
ডিভোর্সের আগে থেকেই এই দুজনের সম্পর্কের কথা জানিয়েছে ইতালির লা গেজেত্তো দেল্লো স্পোর্ত। ডিভোর্সের আবেদনে ওয়ান্দা লোপেজের বিরুদ্ধে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক রাখার অভিযোগ এনেছিলেন। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, বিয়েতে জুড়ি হিসেবে থাকা মারিয়ান্না নামের নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক রেখেছিলেন লোপেজ, যখন সন্তানদের সাথে পাশের ঘরেই থাকতেন ওয়ান্দা।
ইকার্দি-ওয়ান্দার বিয়ের ঠিক একমাস আগে ২০১৪ সালের এপ্রিলে সিরি-আ’র ম্যাচে সাম্পাদোরিয়া-ইন্টার মিলান ম্যাচে মুখোমুখি হন ইকার্দি-লোপেজ, যে ম্যাচকে অনেকে ‘ওয়ান্দা ডার্বি’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই ম্যাচের পূর্বে স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লোপেজ তার তিন সন্তানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইকার্দির পোস্ট করা ছবির জন্য অভিযোগ করেন।
জবাবে টুইটারে লোপেজকে তার সন্তানদের খোঁজখবর না রাখার দায়ে অভিযুক্ত করেন ইকার্দি। শুধু তাই না, নিজের টুইটার একাউন্টে লোপেজের ঘুমন্ত এক সন্তানের সাথে ঝিমুনো অবস্থায় এক ছবি প্রকাশ করেন তিনি। এর ঠিক চারদিন পর ‘ওয়ান্দা ডার্বি’ ম্যাচে ইকার্দির সাথে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানান লোপেজ। সেই ম্যাচ ৪-০ গোলে জিতে যায় ইন্টার, ২ গোল করেন ইকার্দি। অন্যদিকে পেনাল্টি মিস করেন লোপেজ। দুই মাস পর নিজের হাতে লোপেজের তিন সন্তানের নামে ট্যাটু লাগিয়ে টুইটারে প্রকাশ করেন ইকার্দি।
ইকার্দি-নারা ওয়ান্দা জুটির ঘরে এখন আরও দুই মেয়ে আছে। ত্রিমুখী প্রেমের জন্য আর্জেন্টিনায় অজনপ্রিয় ইকার্দি। বৈবাহিক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তার নাম এখন আর্জেন্টাইনদের মুখে মুখে। তার অজনপ্রিয়তা এমনই যে, আর্জেন্টিনায় বন্ধুত্ব আর প্রেমের সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতকতার নাম এখন ‘ইকার্দিয়ার’, যার অর্থ- বন্ধুর প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নেওয়া বা চুরি করা। তবে শুরুতে যতটা প্রভাব পড়েছিলো এখন ততটা নেই। যেহেতু ইকার্দি আর ওয়ান্দা নারা এখনও একসাথেই আছেন, ফলে সম্পর্কটা নিয়ে মানুষের গুঞ্জন দিনে দিনে কমছে।
আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো মারাদোনা একবার ইকার্দিকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে আর্জেন্টিনার সাবেক কোচ টাটা মার্টিনো যখন কোপা আমেরিকার স্কোয়াড থেকে তাকে বাদ দিলেন তখন কারণ জানতে চাইলে তিনি বিষয়টাকে নৈতিকতার দৃষ্টিতে দেখার কথা বলেন।
যদিও অনেকে বলছেন মেসি আর হাভিয়ের মাশ্চেরানোর আপত্তির কারণেই রাশিয়া বিশ্বকাপের দলে জায়গা হয়নি ইকার্দির। কিন্তু লোপেজ তা অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য, প্রিয় বন্ধু মেসির সাথে বার্সেলোনায় খেলেছেন লোপেজ। আর মাশ্চেরানোর সাথে ২০০৪ সালে আর্জেন্টিনার রিভার প্লেটে খেলেছেন।
ফুটবলে কোচদের অনেক সময়ই আবেগকে প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। ইকার্দির ক্ষেত্রেও এমনই কিছু কাজ করেছে। কারণ, ইকার্দির বিতর্কিত ব্যক্তি জীবন। অন্যের স্ত্রী ভাগিয়ে নেওয়া আবার সেই নারীকে নিজের এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা, সবচেয়ে বিতর্কিত হলো নিজেদের যৌন জীবন প্রকাশ্যে আনা। এমন কিছু মেসি বা মাশ্চেরানোর ক্ষেত্রে ভাবাই যায় না।
তবে আর্জেন্টাইন সাংবাদিক লিসত্তোর দাবি, কিছু মানুষ বলে মেসি আর ইকার্দির সম্পর্ক খারাপ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরক্তিকর উপস্থিতি হয়তো কারণ (দলে না রাখা)। তবে এটা শুধুই অনুমান। এমন কোনো প্রমাণ নেই যাতে বলা যায় যে, মেসির কারণেই বিশ্বকাপে যাওয়া হচ্ছে না ইকার্দির। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে ইকার্দিকে।
অন্যদিকে আরেক আর্জেন্টাইন সাংবাদিক বুস্তোস মিল্লা বলেন, বহু আর্জেন্টাইন মনে করেন হিগুয়েনের বদলে ইকার্দির দলে থাকা উচিত ছিল। তারা ইকার্দিকে ভালোবাসে না কিংবা তাকে সেরাও ভাবে না। তবে হিগুয়েনের চেয়ে তাকেই বেশি যোগ্য মনে করে। বিতর্ক হতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার ৯ নম্বর জার্সির পরবর্তী দাবিদার ইকার্দি। তিনিই আর্জেন্টিনার ভবিষ্যত।
মিল্লা আরও বলেন, আমরা জানি, সে (ইকার্দি) একজন যোদ্ধা। মারাদোনা কিংবা চে গুয়েভারার মতোই সে এমন এক ব্যক্তি যে কোন নিয়ম মানে না। কিন্তু এই কারণেই তারা শক্তিশালী। যদি ইকার্দি নিয়ম মেনে চলতো, তাহলে আজকের মতো খেলোয়াড় সে নাও হতে পারতো। অনেকটা মারিও বালতেল্লি কিংবা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের মতো খেলোয়াড় যারা বড় অহংবোধ ও তীব্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যোদ্ধা। আমরা আর্জেন্টাইনরা শুরুতে যোদ্ধাদের অপছন্দ করি, কিন্তু দিনশেষে তারাই আমাদের শাসন করে। আমরা তাতে বিমোহিত হই। আমরা ইকার্দির মতো যোদ্ধাদেরই শেষ মুহূর্তে পছন্দ করি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৮
এমএইচএম/এমজেএফ