‘লিওকে ধন্যবাদ’ সান্তা ফে প্রভিনেন্সের ছোট শহর পুজাতোতে গেলে এমন লেখা একটা মূর্তি দেখতে পাবেন আপনি। এখানেই জন্ম আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনির।
আলবার্তো ‘বেতো’ হিয়ানফেলেকি স্কালোনিকে ছোটবেলা থেকেই চেনেন। পুজোতোর ক্লাব স্পের্তিবো মাতিয়েনহোর হয়ে যখন তিনি খেলছেন, স্কালোনি বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ছিলেন তখন। তাকে ছোটবেলায় দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে হিয়ানফেলেকি বলছিলেন, ‘স্কালোনি ছিল বিশ্রামহীন, দুষ্ট। ফুটবলে বেঁচে থাকতো। একদমই অল্প বয়সে খেলা শুরু করেছিল। বল সঙ্গে করেই ওর জন্ম, কোল বালিশের বদলে পাশে বল নিয়ে ঘুমাতো। ’
হিয়ানফেলেকি যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে বার সেন্ট্রালে। রাজধানী বুইন্স আইরেস থেকে প্রায় সাড়ে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে, যেখানের মানুষ কৃষিতে বেশ উন্নত।
‘লিওনেলের সব বিষয়েই এক ধরনের গান পাউডার থাকতো ও যখন বাচ্চা ছিল। খেলায়, প্রতিবাদে সব জায়গাতেই- ও ছিল দুধর্ষ। এখনকার সঙ্গে একদমই মিল নেই। তার ওই মেজাজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে কয়েক বছর আপনি দেখেছেন। কিন্তু তার মেজাজ ও রক্তে গরম আছে। ’
১৬মে ১৯৭৮ সালে জন্ম স্কালোনির। নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে খেলতে নিজের শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের রোজারিওতে চলে গিয়েছিলেন ১৬ বছর বয়সে। এই ক্লাবের হয়েই ফার্স্ট ডিভিশনে অভিষেক হয় ১৯৯৫ সালে।
এক বছর পর এস্তাদিও ডে লা প্লাতাতে আসেন, ইউরোপে যাওয়ার আগে অবধি থাকেন এখানে। এরপর দেপার্তিভো লা করুনা, ওয়েস্ট হ্যাম, রেসিং স্ট্যান্ডার্ড হয়ে ইতালিরর লাজিও থেকে আতালান্তাতে এসে অবসর নেন ২০১৫ সালে।
খেলোয়াড়ী জীবন এমনিতে বেশ লম্বাই ছিল স্কালোনির। ১৯৯৭ সালে মালেশিয়াতে হোসে প্যাকারম্যানের অধীনে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন। কোচিংয়েও স্কালোনির জন্য আদর্শ তিনি। এরপর ২০০৬ বিশ্বকাপেও প্যাকারম্যানের কোচিংয়েই খেলেছেন স্কালোনি।
২০১৮ সালে এসে জাতীয় দলের দায়িত্ব যখন নেন, তখন অনেক প্রশ্নই উঠে এসেছে অভিজ্ঞতা নিয়ে। বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে দল বাদ পড়েছে, হোর্হে সাম্পাওলি এরপর বিদায় বলেছেন। এমন সময় কি না আলবিসেলেস্তেদের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে সহকারী কোচ যারা যার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, এমন একজনকে!
বেতো বলছিলেন, ‘আমি অবাক হইনি স্কালোনি দায়িত্ব নেওয়ায়। একদম ছোট বেলা থেকেই ওর অনেক সাহস। কখনও চ্যালেঞ্জে ভয় পায়নি, এজন্য একদমই অবাক হইনি। তাকে কাজ করতে না দিয়েই সমালোচনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট লাগতো। তখনই বলেছি কাজ করতে দিলে, স্কালোনি সফল হবে। সে ভুল কিছু করছে না। ’
বেতো অবশ্য ঠিকই ছিলেন, প্রমাণ করেছেন স্কালোনি। ২৮ বছর পর দেশকে শিরোপা এনে দিয়েছেন ব্রাজিলের মাটিতে তাদের হারিয়ে।
ব্যক্তি জীবনে স্কালোনি একদমই আলাদা। সময় পেলেই নিজের শহরে ফিরে যান, বৃদ্ধ বাবা-মা গ্রামেই থাকেন; তাদের দেখে আসেন। মধ্যরাতে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেলে শুরু করেন সাইকেল চালানো। গ্রামে গেলে ছবি তোলা ও অটোগ্রাফ দিতে কখনো বিরক্ত হন না; সাহায্য করেন নিজের শৈশবের ক্লাবকে।
বার্নান্দো রিভাদাভিয়া স্কুল ২০০ মিটার দূরে ক্লাব মাতিয়েঞ্জা থেকে। ওখানেই প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জেতার পর ওই স্কুলে গিয়ে দেখা করেছিলেন ছাত্রদের সঙ্গে।
ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মারিয়া দেল কারমেন রোমন্থন করছিলেন সেই স্মৃতি, ‘স্কালোনি রোমাঞ্চিত ছিল। বাচ্চাদের বলেছে, কখনো এটা ভুলবে না যাই করো- সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে তোমার আচরণ। খেলা হোক, ফুটবল, কাজ অথবা জীবনই; সবকিছুতেই। ’
‘ওর জ্ঞানী মানুষের মতো মানবতা ও প্রতিভা আছে’ কথাটা বলতে বলতে ৮১ বছর বয়সী প্রধান শিক্ষক ঘুরে দেখাচ্ছিলেন স্কুল। পাশেই ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবে শেখানো হয় নানা দেশের ভাষা, এর সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘স্কালোনি কোনো কিছু পছন্দ করলে, এটা পাওয়ার জন্য অসম্ভব কাজও করে ফেলতে পারতো। ’
নিজের ছাত্র বিশ্বকাপ জিতবেন, এমন আশাও করলেন দেল কারমেন, ‘কল্পনা করে দেখেছি এটা কত বড় ব্যাপার হবে যদি আমাদের শহরের কেউ বিশ্বকাপ জেতে। পুজাতো একটা বড় পরিবার। যখন কেউ সুখে থাকে, সবাই-ই সুখে থাকে। যখন কারো সঙ্গে কিছু ঘটে, আমরা সবাই কষ্ট পাই। ’
*এএফপি অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময় : ১৯২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২২
এমএইচবি