ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মাতৃত্বকালীন ভাতা‌ভোগী নির্বাচ‌নে অনিয়‌মের অভি‌যোগ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০২৩
মাতৃত্বকালীন ভাতা‌ভোগী নির্বাচ‌নে অনিয়‌মের অভি‌যোগ

খুলনা: মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূ‌চির আওতায় খুলনার কয়রা উপ‌জেলায় মাতৃত্বকালীন ভাতা‌ভোগী নির্বাচ‌নে অনিয়‌মের অভি‌যোগ পাওয়া গে‌ছে।

৮ম-৭ম শ্রেণি‌তে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মা, অধিক স্বচ্ছল প‌রিবার এমন‌কি তৃতীয় সন্তা‌নের ক্ষে‌ত্রেও নিয়মব‌হির্ভূতভা‌বে এ ভাতা দেওয়া হ‌চ্ছে।

প‌রিবার প‌রিকল্পনা দপ্তর ও ম‌হিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যাল‌য়ের কিছু অসাধু কর্মীর সহ‌যোগিতায় জনপ্রতি‌নি‌ধিরা নিয়মব‌হির্ভূতভা‌বে অযোগ্যদের তা‌লিকাভুক্ত কর‌ার সু‌যোগ পা‌চ্ছে। স্বজনপ্রী‌তি ও অর্থ বা‌ণিজ্যেরও ব‌্যাপক অভি‌যোগ র‌য়ে‌ছে। অনুসন্ধা‌নে খুলনার কয়রা উপ‌জেলায় অনিয়‌মের মাধ‌্যমে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্তির এমন বেশ কিছু চিত্র উঠে এসেছে।

খুলনা কয়রা উপ‌জেলা ম‌হিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ও বি‌ভিন্ন এলাকায় খোঁজ নি‌য়ে জানা যায়, কয়রা উপ‌জেলার মহারাজপুর ইউনিয়‌নের লোকা গ্রা‌মের কামরুল ঢালী ও মোছা. হোস‌নেয়ারা খাতুন দম্প‌তির ২য় সন্তা‌নের জন‌্য মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া হ‌চ্ছে। ত‌বে তা‌দের ২য় সন্তা‌ন এক‌টি মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণি‌তে প‌ড়েন। বয়স ১৩ বছর। আবেদ‌নের সঙ্গে জমা দেওয়া গর্ভকালীন সেবা কা‌র্ডে (এএন‌সি) ২য় সন্তা‌ন গ‌র্ভে র‌য়ে‌ছে ম‌র্মে নি‌শ্চিত ক‌রেন মহারাজপুর ইউনিয়‌নের প‌রিবার কল‌্যাণ প‌রিদ‌র্শিকা (এফড‌ব্লিউ‌ভি) আমেনা খানম।  

হোস‌নেয়ারা‌কে গর্ভকালীন সেবা কার্ড দেওয়ার বিষয়‌টির সত‌্যতা স্বীকার ক‌রে আমেনা খানম ব‌লেন, গর্ভাবস্থায় চেকআপ কর‌তে এলে সেবা কার্ড দেওয়া হয়। হয়তো তৃতীয় সন্তানের জন‌্য চেকআপ কর‌তে এসে তথ‌্য গোপন ক‌রে আমা‌কে ২য় সন্তান ব‌লে‌ছিল। আমরা তা‌দের কথায় বিশ্বাস ক‌রে লি‌খি, বা‌ড়ি গি‌য়ে ‌তো দে‌খি না যে কয় সন্তান র‌য়ে‌ছে।

অপর এক প্রশ্নের জবা‌বে আমেনা খানম ব‌লেন, অনেকে সুপা‌রিশ ক‌রেন। তারপ‌রেও চেকআপ ছাড়া কার্ড দেওয়া হয় না।  

অ‌ন্যান্য কা‌র্ডের বিষ‌য়ে আমেনা খানম ব‌লেন, ফ্লুইড ব‌্যবহার করে য‌দি কেউ নি‌জের নাম বসায় তার দায়ভার‌ তো আমার না।

একই গ্রা‌মের মো. আজিজুল হক ও রা‌শিদা খাতু‌ন দম্প‌তির তিন‌টি সন্তান। ১ম ও ২য় সন্তা‌নের ‌ক্ষে‌ত্রে ছাড়া মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়ার নিয়ম না থাক‌লেও তৃতীয় সন্তা‌নের গর্ভকালীন সেবা কা‌র্ড দ্বারা আবেদন ক‌রেও তি‌নি ভাতা পা‌চ্ছেন। ত‌বে এএন‌সি কা‌র্ডে তৃতীয় সন্তান উল্লেখ থাক‌লেও চূড়ান্ত তা‌লিকায় ২য় সন্তান দেখা‌নো হ‌য়ে‌ছে। কিন্তু তার ২য় সন্তা‌নের বয়স ১২ বছর।

একই ইউনিয়নের জয়পুর গ্রা‌মের রেশমা খাতুন ১ম সন্তা‌নের জন‌্য ভাতা পা‌চ্ছেন। তার প্রথম সন্তান ২য় শ্রেণি‌তে প‌ড়ে। বয়স আট বছর। আবেদনের সময় জমা দেওয়া গর্ভকালীন সেবা কা‌র্ডে প‌রিবার প‌রিকল্পনা দপ্ত‌রের কোনো কর্মীর সই নেই।

জানা যায়, ইউনিয়ন প‌রিষদ থে‌কে ম‌হিলা বিষয়ক কর্মকর্তার দপ্ত‌রে পাঠানো প্রাথ‌মিক তা‌লিকার ব‌্যক্তি‌দের অধিকাং‌রের আবেদনপত্র সম্পূর্ণ ফাঁকা। আবেদ‌নে শুধুমাত্র আবেদনকারীর সই ছাড়া কোনো কিছুই নেই। তারপ‌রেও যাচাই-বাছাই‌য়ের সময় সেগু‌লো বাদ না দি‌য়ে অজানা কার‌ণে গ্রহণ করা হ‌য়ে‌ছে। এমন‌কি গ‌র্ভে সন্তা‌ন র‌য়ে‌ছে কিনা সেটার নিশ্চয়তা প্রদানকারী গর্ভকালীন সেবা কা‌র্ডে কর্মীর সই নেই, অসম্পূর্ণ, ফ্লু‌য়েড ব‌্যবহার করা, ৩য় সন্তান লেখা থাক‌লেও যাচাই বাছাই‌য়ের সময় ত্রু‌টিপূর্ণ হি‌সে‌বে বাদ দেয়া হয়‌নি।

সর্ব‌শেষ মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়ার উপকারভোগীর তা‌লিকা করা হয় ২০২০-২১ অর্থবছ‌রে। এরপ‌রে দীর্ঘ‌দিন আর কোনো তা‌লিকা তৈ‌রির নি‌র্দেশনা আসেনি। সম্প্রতি মন্ত্রণালয় থে‌কে ২০২২-২০২৩ অর্থবছ‌রের গর্ভবতী‌দের তা‌লিকাভুক্ত করার নি‌র্দেশনা দেওয়া হয়। ত‌বে ২০২২-২০২৩ অর্থবছ‌রের ভাতা‌ভোগী‌দের চূড়ান্ত তা‌লিকা এখনও পর্যন্ত তৈ‌রি হয়‌নি। নতুন তা‌লিকা প্রস্তু‌তি‌তেও অনিয়ম করা হ‌চ্ছে ব‌লে একা‌ধিক অভিযোগ র‌য়ে‌ছে। ২০২০-২১ অর্থবছর ও ২০১৯-২০ অর্থবছ‌রের ভাতা‌ভোগীরা এখনও টাকা পা‌চ্ছেন। ওই দুই অর্থবছ‌রের তা‌লিকাভুক্ত করা কয়রা উপ‌জেলার ভাতা‌ভোগী‌দের সম্প‌র্কে খোঁজ নি‌য়ে এমন অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। অনিয়‌মের মাধ‌্যমে শুধু উপ‌রোক্ত তিনজন তা‌লিকাভুক্ত হয়‌নি। ওই দুই অর্থবছ‌রের তা‌লিকায় এ ধর‌নের আরও বেশ ক‌য়েকজন র‌য়ে‌ছে বলে জানা গে‌ছে।

২০১৯-২০ অর্থবছ‌রে কয়রা উপ‌জেলা ম‌হিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ছি‌লেন নাজমুল হো‌সেন। তি‌নি ব‌লেন, আমি পাইকগাছা উপ‌জেলার সঙ্গে অতি‌রিক্ত দা‌য়ি‌ত্বে ছিলাম। এজন‌্য ভা‌লোভা‌বে যাচাই-বাছাই করার সময় পেতাম না। ভুল হ‌তে পা‌রে অথবা কেউ তথ‌্য গোপন কর‌তে পা‌রে। এ ব‌্যাপা‌রে অফিস সহকারী আব্দুর রহমান ভা‌লো বল‌তে পার‌বেন। তি‌নি সব দেখ‌তেন, আমি শুধু সই করতাম।

এমন দায়সারা কাজ সম্প‌র্কে জান‌তে চাইলে উপ‌জেলা মহিলা বিষয়ক দপ্ত‌রের প্রধান অফিস সহকারী আব্দুর রহমান জানান, যাচাই বাছাই করার ক্ষমতা আমার নেই। ইউনিয়ন প‌রিষদ থে‌কে চেয়ারম‌্যানরা যে তা‌লিকা পাঠাতেন আমি সেটার কোনো প‌রিবর্তন ছাড়াই স‌্যা‌রের কাছে সই করতে দিতাম।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস‌্য মোস্তফা কামাল ব‌লেন, সব জায়গায় কিছু স্বজনপ্রী‌তি ও অনিয়ম র‌য়ে‌ছে। মাতৃত্বভাতার তা‌লিকা প্রস্তু‌তে আমা‌দের তেমন কোনো দা‌য়িত্ব দেওয়া হতো না। ম‌হিলা মেম্বার ও চেয়ারম‌্যান কর‌তো।

তা‌লিকায় স্বাক্ষ‌রিত মহারাজপুর ইউনিয়‌ন প‌রিষ‌দের সা‌বেক চেয়ারম‌্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলু বাংলানিউজকে ব‌লেন, প‌রিবার প‌রিকল্পনা দপ্ত‌রের কর্মী‌রা গর্ভবতীর কার্ড দেয়। তা‌দের কার্ড দে‌খে আমরা তা‌লিকা তৈ‌রি ক‌রি। আমরা ভোট ক‌রি, সব জনগণ‌কে নি‌য়ে চল‌তে হয়। এজন‌্য গ‌র্ভে সন্তান আছে কিনা কিংবা কততম সন্তান আছে আমরা‌তো এতো যাচাই-বাছাই ক‌র‌তে পা‌রি না। জনগ‌ণের কথায় বিশ্বাস রাখ‌তে হয়। আর ম‌হিলা বিষয়ক কর্মকর্তারাও ঠিকমত যাচাই-বাছাই ক‌রেন না।

অভিযোগের বিষয়ে বুধবার (৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় কয়রা উপ‌জেলা ম‌হিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেশমা আক্তার বাংলানিউজকে ব‌লেন, অভিযোগগুলো আমি পেয়েছি। এগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০২৩
এমআরএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।