ঢাকা, সোমবার, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ডেঙ্গু পরিস্থিতির জন্য সরকারের চরম অব্যবস্থাপনা দায়ী: ড্যাব

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২৩
ডেঙ্গু পরিস্থিতির জন্য সরকারের চরম অব্যবস্থাপনা দায়ী: ড্যাব ছবি: জি এম মুজিবুর 

ঢাকা: দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের চরম অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে সংগঠনটি।

 

বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এই উদ্বেগ জানায় ড্যাব। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ড্যাব মহাসচিব ডা. মো. আব্দুস সালাম।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, চলতি বছরের শুরু থেকেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। বিগত কয়েক বছর ধরেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকলেও এই বছর এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস সত্ত্বেও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উদাসীনতা, সমন্বয়ের অভাব, জলবায়ুর পরিবর্তনসহ এডিস মশার বিবর্তনসহ নানা কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করার ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে আগামী আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের আভাস ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। সরকারিভাবেই বলা হচ্ছে দেশের ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন।  

তবে দেশে কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ রূপ আর কখনো দেখা যায়নি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ২০৮ জন। মারা গিয়েছিলেন ৮ জন।

এই বছর এখন পর্যন্ত পাওয়া সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১০ হাজার ২৯২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং নয় হাজারের বেশি আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাব থেকে অনেক বেশি।  

গত কয়েকদিন গড়ে প্রতিদিন ৬০০ এর কাছাকাছি মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যদিও এ হিসাব ঢাকার ৫৩টি হাসপাতাল ও বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য। এই হাসপাতালগুলো ছাড়াও ছোট বড় অনেক বেসরকারি ক্লিনিক ও বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন আরও অনেক রোগী। যেসব ক্লিনিক বা হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তথ্য পাঠায় না, সেই রোগীদের হিসাব ডেঙ্গু পরিসংখ্যানে যুক্ত হয় না।

রাজধানীর বাইরের অবস্থা

ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ভর্তি রোগীর প্রায় ২৯ শতাংশ রাজধানীর বাইরের।

অবস্থার অবনতি এতোটাই ভয়াবহ যে চট্টগ্রামে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি গতবারের চেয়েও আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে গত ৬ জুলাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী সার্জন। একইভাবে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককেও (সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ) উদ্বেগের কথা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। করপোরেশনের মেয়রকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, বর্ষা মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে করপোরেশন এলাকায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগী দ্রুত বাড়ছে, যা গত বছরের তুলনায় আশঙ্কাজনক।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বিস্তারের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯, ২০২১ ও ২০২২ সালেও ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। কাজেই এখন এডিস আর শহরের মশা নয়। শহর থেকে মফস্বল কোথাও যে মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমই নেই এটা তাই প্রমাণ করে।

প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে এই মুহূর্তে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন বলে জানা যায়। নার্স এবং চিকিৎসক সংকটও প্রবল আকার ধারণ করেছে। বেডের অভাবে রোগীদের মেঝেতে শুইয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সর্বত্র। ডেঙ্গুতে প্রাণহানি কমানো এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোগী দ্রুত শনাক্ত জরুরি। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার কথা বললেও নেওয়া হচ্ছে না তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ।

টায়ার কিংবা নির্মাণ প্রকল্পে যেন এডিস মশা জন্মাতে না পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ থেকে দেখা গেছে, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে যেসব উৎসে, সেগুলো হলো পরিত্যক্ত টায়ার (২২.৯০ শতাংশ), বেজমেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি (১১.২৯ শতাংশ), প্লাস্টিকের ড্রাম (৭.৭৪ শতাংশ) ইত্যাদি। এছাড়া আর যেসব স্থানে এডিস মশা পাওয়া যায় সেগুলো হলো, পানির ট্যাংকি (৪.৮৪ শতাংশ), প্লাস্টিকের বালতি (৪.৮৪ শতাংশ), ফুলের টব ও ট্রে (৩.৮৭শতাংশ), মাটির পাত্র (৩.৮৭ শতাংশ), রঙের কৌটা (৩.৫৫ শতাংশ), টিনের ক্যান (৩.২৩ শতাংশ), প্লাস্টিকের মগ/বদনা (২.৯০ শতাংশ) ইত্যাদি।

সরকারি হিসাবেই ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এর পরও ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া জেলা-উপজেলা শহর ও গ্রামে মশকনিধন কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়ছে না। সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চললেও জনবল ও যন্ত্রপাতির অনেক ঘাটতি রয়েছে। তবে পৌর এলাকার পরিস্থিতি অনেকটাই নাজুক। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মশক নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রমই নেই। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব ইউনিয়ন পরিষদই মশা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র, ওষুধ ও জনবলশূন্য।

এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা কর্তৃপক্ষের ছিল না। যেটুকু উদ্যোগ দেখা গেছে, তা পরিস্থিতি বিবেচনায় অপ্রতুল।

এ অবস্থায় বেশ কিছু করণীয় জানিয়েছে ড্যাব। এগুলো হলো-

• ডেঙ্গু সব জায়গায় একবারে ছড়ায় না, কোনো কোনো অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। সময়মতো শুরুর দিকের ক্লাস্টারগুলোতে ডেঙ্গু দমনের যথাযথ পদক্ষেপ নিলে সহজে ছড়াতে পারে না। সারা বছর ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ঠিকানার মাধ্যমে এ ধরনের ডেঙ্গু ক্লাসটারগুলো শনাক্ত করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

• অবিলম্বে সকল সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসক নার্স সংকট মোকাবিলার জন্য নার্সিং ইন্সটিটিউট ও মেডিকেল কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের কাজে লাগানো যেতে পারে।  

• ডেঙ্গুতে শিশুদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অল্পতেই মারাত্মক আকার ধারণ করে বিধায় শিশুদের জন্য প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর জন্য ঢাকা শহরে কয়েকটি ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা যেতে পারে।

• আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এই মুহূর্ত থেকেই সারাদেশে এডিস মশার লার্ভা শনাক্ত এবং ধ্বংসের উদ্যোগ নিতে হবে।

• ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে সারাদেশে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ এবং আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

• পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশ বিদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে তাদের পরামর্শ মোতাবেক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

• সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলার জন্য চিকিৎসা অবকাঠামো প্রস্তুত এবং ২৪ ঘণ্টা ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২৩
এমকে/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।