ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ত্বকের ক্যান্সার সম্পর্কে যা জানা দরকার

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪
ত্বকের ক্যান্সার সম্পর্কে যা জানা দরকার

ত্বকের ক্যান্সার সারা বিশ্বজুড়ে অন্যতম গুরুতর একটি মরণঘাতি রোগ। এটি এমন একটি রোগ যা ত্বকের কোষগুলি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে।

সাধারণত সূর্য থেকে অতিবেগুনী (ইউভি) রশ্মি বিকিরণের কারণে ঘটে, ককেশীয় (সাদা চামড়াযুক্ত) লোকেরা ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি কারণ ‘মেলানিন’ এর অভাব যা যথেষ্ট পরিমাণে ইউভি রেডিয়েশনকে আটকাতে সহায়তা করে। তবে ত্বকের ক্যান্সার সারা বিশ্বে যে কোনো ত্বকের বর্ণের মানুষদের হতে পারে। বাদামি এবং কালো ত্বকের বর্ণযুক্ত লোকদের প্রায়শই শেষ পর্যায়ে ত্বকের ক্যান্সার ধরা পড়ে। বয়সের শেষ পর্যায়ে রোগটা ধরা পড়ায় চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পরে।

আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে ত্বকের ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের ‘ত্বকের ক্যান্সার রাজধানী’ নামে পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ান দুই তৃতীয়াংশ লোক তাদের জীবদ্দশায় ত্বকের ক্যান্সারে ভুগছেন।

তিনটি বিপজ্জনক ধরনের ত্বকের ক্যান্সার রয়েছে

১. বেসাল সেল কার্সিনোমা
২. স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা
৩. মেলানোমা

বেসাল সেল এবং স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা দুটি খুবই কমন ত্বকের ক্যান্সার। মেলানোমা বিরল তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ মস্তিষ্ক, লিভার এবং ফুসফুসসহ শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে এটি।

বেসাল সেল কার্সিনোমা (বিসিসি) 

বেসাল সেল কার্সিনোমা (বিসিসি) ত্বকের ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ ধরন। বেশিরভাগ মুখ এবং ঘাড়ের জায়গাগুলিতে ঘটে থাকে তবে ত্বকের যে কোনো জায়গায় ঘটতে পারে। এ জাতীয় ত্বকের ক্যান্সার সাধারণত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যায় না। তবে দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা না করা হলে, এটি পেশি, কারটিলেজ এবং হাড়কে ধ্বংস করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি নির্ণয় করা গেলে এ ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসা করা সহজ এবং নিরাময়ের হার অনেক বেশি

চিত্র-১: গালের ওপর বেসাল সেল কার্সিনোমা (বিসিসি) সহ ককেশীয় রোগী ডান চোখের নিচে।

চিত্র-২: গালের ওপর বাম চোখের নিচে বেসল সেল কার্সিনোমা (ব্রাউন স্কিন)।

 

স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা

ত্বকের ক্যান্সার বেশ বিপজ্জনক ক্যান্সার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখ, ঘাড় এবং হাতসহ যেখানে সূর্যের রশ্মি বেশি পরে সেখানে এই ধরনের ক্যান্সার বেশি হয়। যাদের মাথায় টাক আছে তাদের মাথার ত্বকে (তালুতে) দেখা দিতে পারে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা না করা হলে এই ধরনের ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে।

যেসব ঘা বা ফুসকুড়ি ছয় মাসের বেশি থাকে, ব্যথা করে বা রক্ত পরে তা অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে কারণ এটা স্ক্যামোস সেল কার্সিনোমা হতে পার। যে কোনো ক্ষত বা ঘা নিরাময় হতে দীর্ঘ সময় নেয়। বিশেষত ক্ষত বা ঘা অনেক আগের পোড়া ত্বকে দেখা দেয়।

চিত্র-৩: বাম কানে স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমাসহ (এসসিসি) ককেশীয় রোগী।

চিত্র-৪: বাদামি ত্বকের রোগী বাম গালে স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (এসসিসি)।

ধূমপায়ীরা তাদের ঠোঁটে স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (এসসিসি) হতে পারে।

চিত্র-৫: নিম্ন ঠোঁটে স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (এসসিসি)


চিত্র-৬: পূর্ববর্তী বার্ন দাগ থেকে উদ্ভূত স্কোয়ামাস কার্সিনোমা


মেলানোমা

মেলানোমা একটি বিরল তবে খুব বিপজ্জনক ক্যান্সার। একটি সাধারণ তিল মেলানোমাতে পরিবর্তিত হতে পারে। অন্যান্য ত্বকের ক্যান্সারের তুলনায় মেলানোমা শরীরের অন্যান্য অংশে দ্রুত ছড়াতে পারে। মেলানোমা শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে তা চিকিৎসা করা খুবই কঠিন বলা যাই মৃত্যু অবসম্ভাবী।  

চিত্র ৭: ব্রাউন ত্বকের রোগীর উরুতে মেলানোমা।

চিত্র ৮ :ত্বকে মেলানোমা (ককেশীয় রোগী)।

সাদাদের তুলনায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর এবং চিনের লোকেরা হাতের তালু, পায়ের তালুতে এবং নখের নিচে মেলানোমা দ্বারা বেশি আক্রান্ত হতে পারে।


চিত্র-৯: নখের নিচে মেলানোমা।  


ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকিপূর্ণ কারণ

ঝুঁকিপূর্ণ ত্বকের ধরন- হালকা ত্বক, নীল বর্ণের চোখ, লাল চুল (খুব উচ্চ ঝুঁকি) যারা রোদ্রে পুড়ে কাজ করে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা রোগীদের যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম অঙ্গ প্রতিস্থাপন রোগীরা। যারা ওয়েল্ডিং মেশিন (কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত রেডিয়েশন) নিয়ে কাজ করেন। বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যাদি।

ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধ

সূর্যের আলো এড়িয়ে চলুন। বিশেষত সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত (গ্রীষ্মকালীন)। বাইরে গেলে বাইরে পর্যাপ্ত পরিমাণে সানস্ক্রিন (SPF 50 plus) লাগাতে হবে।

আপনার যদি ত্বকের ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস থাকে তবে আপনাকে খুব সজাগ থাকতে হবে। নিয়মিতভাবে ত্বকের ক্যান্সার ডাক্তার (ডার্মাটোলজিস্ট) ডাক্তারকে দেখতে হবে।  

রোগ নির্ণয়

ত্বকের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা ত্বকের ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য ডার্মাটোস্কোপ নামের এক ধরনের চিকিৎসার যন্ত্র ব্যবহার করেন। ত্বকের ক্যান্সার পরীক্ষার সময় যদি সন্দেহজনক তিল বা ফুসকুড়ি পাওয়া যায় তখন চিকিৎসকরা ক্যান্সার নিশ্চিত করতে (বায়োপসি) নমুনা নেবেন। বায়োপসি ফলাফলের ওপর নির্ভর করে রোগীদের কোন ধরনের চিকিৎসা ভালো হবে তা নির্ধারণ করবেন এবং পরামর্শ দেবেন।

ত্বকের ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসা

শৈলচিকিৎসা হলো ত্বকের ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে। বিশেষ করে মেলানোমার জন্য। অন্য কোনো বিকল্প চিকিৎসা নেই। অন্যান্য চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে- (স্কোয়ামাস এবং বেসাল সেল কার্সিনোমা)। ক্যান্সার ক্রিম- যে ত্বকের ক্যান্সার ত্বকের ওপরেই আছে, গভীরে যাই নেই। ক্রয়োথেরাপি (ত্বকের ক্যান্সার কোষগুলি হিমায়িত করতে তরল নাইট্রোজেন) স্প্রে- ত্বকের ওপরের ক্যান্সারের জন্য খুব ভালো কাজ করে। ইলেক্ট্রকটেরি এবং লেজার অবলাশন ব্যবহার করা হয় সাধারণত পৃষ্ঠতলে অবস্থিত ত্বকের ক্যান্সারের জন্য। যদি ক্যান্সার ছড়িয়ে পরে তাহলে শৈলচিকিৎসা এবং কেমোথেরাপি/রেডিওথেরাপি লাগবে।  

ত্বকের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা অনেকের জীবন বাঁচাতে পারে

ত্বকের ক্যান্সার বিশ্বজুড়ে একটি বড়ো সমস্যা এবং এটি আজকের সমাজে ক্যান্সার মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ। ত্বকের ক্যান্সার মূলত আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডসহ পশ্চিমা সমাজগুলির মধ্যে জ্বলন্ত সমস্যা। এই ধরনের ক্যান্সার বাদামি এবং কালো ত্বকের মানুষের দেশ গুলিতে (এশীয়, আফ্রিকান এবং দক্ষিণ আমেরিকান) উপেক্ষা করা হয়।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান ভিত্তিক ত্বকের ক্যান্সার চিকিৎসক হিসেবে, আমি দেখতে পেয়েছি বেশিরভাগ সময় ত্বকের ক্যান্সারের সমস্যাগুলি বাংলাদেশের জনগণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। ত্বকের রং নির্বিশেষে বিভিন্ন ধরনের ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে। আমাদের সবার মধ্যে একটি মিথ্যা ধারণা রয়েছে যে বাদামি ত্বকের মানুষদের ত্বকের ক্যান্সার হয় না ,কারণ  মেলানিনের কারণে ইউভি প্রটেকশন থাকে।

এই কারণেই রঙিন ত্বকের লোকদের বেশিরভাগ ত্বকের ক্যান্সার ধরা পরে। বাংলাদেশে ত্বকের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রবণতাগুলির (বায়ু দূষণ এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক) সবার মধ্যে সচেতনতা জাগানো উচিত বলে আমি মনে করি। এবং প্রত্যেককে নিয়মিত ত্বকের ক্যান্সার পরীক্ষা করা উচিত।  

Dr. Parag Das
MBBS, DCH, FRACGP
Diploma in Dermatology
Diploma in Skin cancer surgery
Diploma in Dermatoscopy
Certificate in Botox injection & Dermofiller
Fellowship in Skin cancer (Australian College of cutaneous Oncology.

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।