ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

খুলনার ৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: শুধু নেই আর নেই

মাহবুবুর রহমান মুন্না, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১২
খুলনার ৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: শুধু নেই আর নেই

খুলনা: অ্যাম্বুলেন্স নেই; প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই; প্রাইভেট রোগী দেখায় ব্যস্ত চিকিৎসকরা; রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি নেই; কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই; চিকিৎসক সংকট; রোগীদের সঙ্গে

সেবিকাদের খারাপ আচরণ; চিকিৎসকদের অফিস ফাঁকির প্রতিযোগিতা; দালাল ও রিপ্রেনটেটিভদের দৌরাত্ম্য; রোগীদের দুর্ভোগ নিত্যদিনের; অনিয়মই যেখানে নিয়ম। এ অবস্থা খুলনার ৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।


বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এ চিত্র দেখা দেখা গেছে।

বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ফারজানা মৌ বাংলানিউজকে বলেন, ‍‍ অফিস সময়ের ২/৩ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে চিকিৎসক আসেন। তখন বহির্বিভাগে অপেক্ষমান রোগীর জটলা লেগে যায়। এ সময় রোগী দেখতে ডাক্তারদের তাড়াহুড়ো শুর হয়ে যায়, সময় স্বল্পতায় নামমাত্র চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে বিদায় দেওয়া হয়।

রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন এক রোগীর অভিভাবক রাহেলা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বাংলানিউজকে জানান, ‍‌‌বুধবার রাতে তার মেয়ে অসুস্থ হয়, ওয়ার্ডের নার্সকে অনেক অনুরোধ করলেও তিনি ডাক্তার ডেকে দেননি। যার কারণে ওই রাতে তার মেয়ে ভীষণ যন্ত্রণায় ভুগেছে।

দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের স্কুল শিক্ষক আরমান খান বাংলানিউজকে জানান, দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর চিকিৎসকের দেখা না পেয়ে অনেক সময় নিরাশ হয়ে ফিরতে হয় রোগীদের। নতুবা কম্পাউন্ডারের ছোট এক টুকরো প্রেসক্রিপশনই হয় রোগীর একমাত্র ভরসা।

একই অভিযোগ করেন আইলা দুর্গত কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।

ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে স্থানীয় সাংবাদিক খান মহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসকরা চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

তিনি আরও জানান, অনেক সময় দেখা যায় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের রোগীদের আসনে বসিয়ে নারী রোগীকে দাঁড়িয়ে রেখে চিকিৎসা দেন চিকিৎসকরা।

ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংলগ্ন দামুদার গ্রামের এনজিও কর্মী আয়েশা বেগম বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালে রোগী ডেলিভারির পর ডাক্তার ও নার্সরা মোটা অংকের বকশিস চান। যা অনেক রোগীর পরিবারের পক্ষে বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে।

তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দালালদের দৌরাত্ম্য প্রসঙ্গে হাসপাতাল সংলগ্ন বাজারের মুদি দোকানী সোহেল খান বাংলানিউজকে জানান, প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে রোগী যোগাড় করে দেওয়ার জন্য একশ্রেণীর দালাল রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্রেক্সের মধ্যে। ওইসব দালালরা সরকারি হাসপাতালের গেটের সামনে ওঁত পেতে থাকেন এবং রোগীদের বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যান। একই অবস্থ্য দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

সরেজমিন গত এক সপ্তাহ খুলনা জেলার ৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, প্রায় হাসপাতালে নির্ধারিত সময়ে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি। দেরিতে এসে টিকিটধারী রোগী দেখা শুরু করেন।

দূর-দূরান্ত থেকে আসা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রোগীরা তাকিয়ে থাকেন কখন তার ডাক পড়বে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে তার ডাক পড়ার আগে চিকিৎসক চলে যান।  

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে আরও জটিল অবস্থা। তারা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে সকাল ৮টা থেকে একটানা ২/৩ ঘণ্টা সময় রোগী দেখেন। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে হাসপাতালে যান। হাসপাতালে পৌঁছার পর ভর্তিকৃত রোগীদের একটি রাউন্ডের মাধ্যমে দেখার পর আবারও তারা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর দিকে ছোটেন।

অনেক অসহায় রোগীরা তাদের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে টিকেট সংগ্রহ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে যান। আবার অনেক রোগী গ্রামে গিয়ে কষ্টার্জিত টাকা সংগ্রহ করার পর তারা আবারও ওইসব চিকিৎসকদের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার জন্য ভিড় জমান। এভাবেই চলছে খুলনা জেলার ৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

খুলনা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় ২৩ লাখ ১৮ হাজার ৫২৭ জন মানুষ রয়েছে। তাদের চিকিৎসা সেবার জন্য যে পরিমাণ চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য জনবলের প্রয়োজন তার ব্যাপক সংকট রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে।

দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকসহ ৩০টি পদের বিপরীতে শূন্য ২৩টি, কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৬টি পদের মধ্যে ১১টি শূন্য, রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৪টির মধ্যে ৪টি শূন্য, বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৬টি পদের মধ্যে শূন্য ৪টি, তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫টির মধ্যে ৭টি শূন্য, দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫টি পদের মধ্যে ২টি শূন্য, ফুলতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫টির মধ্যে শূন্য ৯ টি, ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৩টি পদের মধ্যে ৭টি শূন্য ও পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১টি পদের মধ্যে ৮টি পদ শূন্য রয়েছে।

দাকোপ উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বিধান চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, এখানে চিকিৎসক সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। তিনি আরও বলেন, ৫০ শয্যার হলেও অতিরিক্ত রোগী থাকায় হাসপাতালে অনেক সমস্যা দেখা দেয়।

ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ বাংলানিউজকে জানান, এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সবচেয়ে বড় সমস্যা যন্ত্রপাতির অভাব। এ ছাড়া পর্যাপ্ত জনবলের অভাব তো রয়েছে।

বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এমদাদুল হক বাংলানিউজকে জানান, চিকিৎসক কম রোগীর চাপ বেশি। ফলে, ইচ্ছা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।

পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবুল ফজল বাংলানিউজকে জানান, ৩১ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের লোকবল দিয়ে ৫০ শয্যার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। ফলে এ কমপ্লেক্সে সেবা নিতে আসা রোগীদের কিছুটা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।

দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইসহাক আলী বাংলানিউজকে জানান, এখানে মেডিসিন, গাইনী, সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। যার কারণে এসব রোগীদের অন্যত্র যেতে হচ্ছে।

ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. অশোক কুমার দাস বাংলানিউজকে জানান, চিকিৎসকের সংকট থাকায় রোগীরা মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুশান্ত বাংলানিউজকে জানান, এ উপজেলার অধিক জনসংখ্যার বিপরীতে চিকিৎসকের সংখ্যা কম। যার কারণে অনেক সময় তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাদের পাওয়া যায়নি।  

এ বিষয়ে খুলনার সিভিল সার্জন ডা. গোলাম  মোর্ত্তুজা শিকদার বাংলানিউজকে জানান, প্রত্যেকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য জনবলের ব্যাপক সংকট থাকায় চিকিৎসা কার্যক্রম অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। চিকিৎসকের শূন্য পদে নিয়োগের জন্য ঢাকায় কয়েকবার আবেদন পত্র পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সময় : ১২০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, প্রভাষ চৌধুরী, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।