ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

প্রতিরোধযোগ্য ডেঙ্গুতেও শত শত মৃত্যু, দায় কার?

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২৪
প্রতিরোধযোগ্য ডেঙ্গুতেও শত শত মৃত্যু, দায় কার?

ঢাকা: চলতি বছরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে মোট ৪২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু অক্টোবরেই মারা গেছেন ১৩৫ জন।

এছাড়া চলতি নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত মোট ১১২ জন মারা গেছেন। পাশাপাশি এ বছরে এখন পর্যন্ত মোট ৮৩ হাজার ১৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশে সাধারণত গ্রীষ্মকালে ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সারা বছরই এ জ্বরের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতের বছরগুলোতে শহরের বাসা বাড়িতে আবাসিক ধরনের মশা (এডিস ইজিপ্টি) ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটালেও বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বুনো মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) এ রোগের বাহক হিসেবে কাজ করছে। গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এটি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত প্রতিরোধযোগ্য রোগ। প্রথমত মশার প্রজনন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত উড়ন্ত মশাগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কেউ যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তাকে পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গুর কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি উল্লিখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে পালন করলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যু কমানো সম্ভব।    

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে আড়াই হাজার জন আক্রান্ত হন এবং ৪৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ছয় হাজার ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে ৫৮ জন মারা যান। ২০০৩ সালে ৪৮৬ জনের মধ্যে ১০ জন, ২০০৪ সালে চার হাজারের মধ্যে ১৩ জন, ২০০৫ সালে এক হাজারের মধ্যে চারজন, ২০০৬ সালে দুই হাজারের মধ্যে মৃত্যু হয় ১১ জনের। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও কারও মৃত্যু হয়নি।

২০১১ সালে দেড় হাজারের ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ৬৭১ জনের মধ্যে একজন, ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজারের মধ্যে দুজন ডেঙ্গুরোগী মারা যান। ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে তিন হাজারের মধ্যে ছয়জন, ২০১৬ সালে ছয় হাজারের মধ্যে ১৪ জন, ২০১৭ সালে তিন হাজারের মধ্যে আটজন, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে ২৬ জন, ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জনের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যান।  

২০২০ সালে দেড় হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয় চারজনের। আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার, মারা যান ১০৫ জন। ২০২২ সালে সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং মোট ২৮১ জন মারা যান। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়, পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর যথেষ্ট কার্যক্রমে বড় ধরনের ঘাটতি আছে, এর ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক গতিতে বাড়ছে। পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে অসচেতনতাও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর আরেকটি কারণ।

এ বছর নভেম্বরেও কেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বাংলানিউজকে বলেন, অক্টোবর মাসেই আমি স্পষ্টভাবে বলেছিলাম চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশ ব্যাপক থাকবে। আমরা প্রতিদিন এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে কাজ করি। আমরা দেখছি এখনও এডিস মশার ঘনত্ব কমেনি।

তিনি বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব যখন ২০ এর ওপরে থাকে, তখন ধরে নেওয়া হয় এডিস মশা বাড়বে। এডিস মশার ঘনত্বের পাশাপাশি কোনো জায়গায় যদি ডেঙ্গুরোগী থাকে তাহলে এডিস মশা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বর্তমানে আমাদের এডিস মশাও আছে আবার রোগীও আছে, দুইটা বিষয় যখন একসাথে থাকে তখন ডেঙ্গু বাড়বে এবং সেটা থাকবে। এ কারণেই আমরা আগেই বলেছিলাম এবার নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গু বেশ ভালো আকারে থাকবে। চলতি বছরের নভেম্বরে আমরা ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ চিত্র দেখলাম এর আগে বাংলাদেশে তা কখনই হয় নাই।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো ব্যবস্থাও আমি বলেছিলাম। কিন্তু এখন না শুধু কখনোই আমাদের কথা কেউ শোনে নাই। এছাড়াও স্থানীয় সরকার কাঠামোতে এবার ব্যাপক একটা ধাক্কা লেগেছে, তার প্রভাবও রয়েছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যু কমানো যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধের যে স্তরগুলো রয়েছে তার প্রথম ধাপ হচ্ছে এডিস মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ। সারা দেশব্যাপী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কোনো কার্যক্রম বা পরিকল্পনা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় নাই। ফলে মশা মারার যে কার্যক্রম সেটি কখনোই শুরু হয় নাই। কিছু কিছু স্থান ভিত্তিক মশা মারার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

তিনি বলেন, মশা মারতে সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাসেবক, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় পরিষদের লোকজনসহ সবাইকে যুক্ত করাও হয় নাই। মানুষ তার বাড়িঘরে কীভাবে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করবে, হাতে কলমে সেটা শেখানোর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয় নাই। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ, সেটাও আমরা দেখিনি। এর আগে যে ওষুধগুলো ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো খেয়ে মশা মারা যায়নি।

এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গুর হটস্পট ম্যানেজমেন্টও দেখা যায়নি। ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন দেওয়ার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নাই। ফলে মশা নির্মূল করার জন্য যে কার্যক্রম সেগুলো গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে এডিস মশার বিষয়েও কোনো গবেষণাও আমরা করছি না। আমরা দেশে ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের কোনো কার্যক্রম শুরু করি নাই। এসব কারণেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।  মানুষকে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং নিজের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচার প্রকাশনাও নাই।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২৪
আরকেআর/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।