ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মুমূর্ষু রোগীর আর্তনাদও ঝিনাইদহ হাসপাতালের ডাক্তারের মন গলায় না

আসিফ ইকবাল কাজল, ঝিনাইদহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১২
মুমূর্ষু রোগীর আর্তনাদও ঝিনাইদহ  হাসপাতালের ডাক্তারের মন গলায় না

ঝিনাইদহ: এক’শ বেডের ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছেন ১৫০ জন রোগী। আর বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নেন ৫শ জন।

ভৌগলিক কারণে দিনকে দিন এ হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও চিকিৎসক, শয্যা সংখ্যা ও ওষুধ বাড়ছে না।
 
রোগীর অত্যাধিক চাপ, জনবল ও বেড সংকটের মাঝে এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ঝিনাইদহের ১৮ লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি চিকিৎসালয়টি। নানা সংকটে হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগী।
 
১৯৯৪ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হাসপাতালটি ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ব্যাপারটি ‘নামেই তাল পুকুর, ঘটি ডোবে না’ এর মতো!

সরকারিভাবে ১শ বেডের খাবার, শয্যা ও ওষুধ সরবরাহ করা হলেও চিকিৎসার মুল ভরসা সেই ডাক্তার তথা জনবল নিয়োগ সম্ভব হয়নি ১৮ বছরেও। ফলে পদে পদে রোগীদের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ সকাল ৮টার সময় অফিস সময় শুরু হয়ে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত চলার নিয়ম থাকলেও যথা সময়ে ডাক্তার আসেন না। দেরিতে এসে তারা আবার আগে ভাগে চলে যান বলে অভিযোগ।

রোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে প্রতিদিন ডাক্তাররা আসেন ১০টার দিকে। এরপর তারা আবাসিক মেডিকেল অফিসারের কক্ষে কিছু সময় আড্ডা দিয়ে রোগী দেখতে বসেন।

মেডিকেল অফিসাররা নিজ নিজ চেম্বার ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা ভর্তি হওয়া রোগীদের দেখতে রাউন্ডে বের হন। রাউন্ড শেষ করে বেশির ভাগ সময় তাদের (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) চেম্বারে আসতে ১২টা গড়িয়ে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে চেম্বারের বাইরে অপেক্ষমান মুমুর্ষ ও সাধারণ রোগীদের অবস্থা হয় ত্রাহী দশা।
 
ঝিনাইদহ শহরের ব্যাপারী পাড়ার হাসান মাহমুদ নামে এক রোগী জানান, পাঁচ টাকা দিয়ে লাইনে দাড়িয়ে টিকেট কাটার পর রোগীদের যন্ত্রণা ও হয়রানি আরও বেড়ে যায়।

তার ভাষ্যমতে টিকিটের ওপর রুম নাম্বার থাকায় ওই নাম্বার যুক্ত কক্ষে বসা ডাক্তার ছাড়া আর কেউ রোগী দেখেন না। অন্য ডাক্তারকে দেখাতে হলে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের কাছ থেকে রেফার্ড করে আনতে হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল রোগীদের এ প্রক্রিয়া শেষ করতে হিমশিম খেতে হয়। এরপরও রয়েছে নার্স ও ডাক্তারদের অসৌজন্য আচরণ আর পরীক্ষা নিরীক্ষার ঝক্কি ঝামেলা।

জরিনা বেগম নামে এক রোগী জানান, তিনি দাঁতের ডাক্তার দিয়ে দেখাবেন বলে সাধুহাটী ইউনিয়ন থেকে এসেছেন। কিন্তু দুপুর ১২টা বাজার পর আর টিকিট দেওয়া হয় না।
 
তিনি জানান, ডাক্তার রোগী দেখতে চাইলেও কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতারা যেন বাশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত’র মতো ক্ষমতা দেখান। ফলে এভাবে অনেক রোগী দুর দুরান্ত থেকে এসে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান।

অভিযোগ পাওয়া গেছে জোহরের আজান শোনা মাত্রই দুপুর দেড়টার দিকে বেশির ভাগ ডাক্তার চেম্বার ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেন। এসময় কোনো মুমুর্ষু রোগীর আর্তনাদও তাদের মনকে বিন্দু মাত্র গলাতে পারে না।

হাসপাতালে আসা যাওয়ার এ দৃশ্য প্রতিদিনের হলেও ডাক্তারদের দেখভাল করার মতো কেউ নেই। কারণ হাসপাতালে স্থায়ী কোনো তত্বাবধায়কের পদ নেই। সিভিল সার্জন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মাঝে মধ্যে বসেন।

অভিযোগ আছে, রাতের বেলা জরুরি বিভাগ ছাড়া ডাক্তার থাকেন না। নিয়ম আছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রাতে প্রতিদিন রাউন্ড দেবেন। কিন্তু তা তারা করেন না। মরে গেলেও রাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের টিকি দেখা পান না রোগীরা।
 
পোড়াহাটী গ্রামের রহমত আলী নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন হাসপাতালের জরুরিসহ বিভিন্ন বিভাগে সেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বেসরকারি লোকেরা রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন।

জরুরি বিভাগ থেকে লাশ নামাতে হলেও সেচ্ছাসেবকদের খুশি করতে হয়। টুকিটাকী কাটা ছেড়া সেলাই করতে হলে তারা টাকা দাবি করে বসেন।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ১৮৯০ সালের দিকে শহরের ছবিঘর সিনেমা হলের পশ্চিম দিকে ব্রিটিশ আমলে ১০ শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭০ সালে হাসপাতালটি লোকালয় থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করে হামদহ এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে স্থাপন করা হয়।
 
হাসপাতালটি স্বাধীনতার পর ৪২ বছর অতিবাহিত হলেও সেই সময়কার জনবল কাঠামো এখনও হাসপাতালে বিদ্যমান। মাত্র ১৮ জন ডাক্তার দিয়ে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালটি চালানো হয়।

সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আইয়ূব হোসেন বাংলানিউজকে জানান, আশপাশের হাসপাতালগুলো আড়াইশ বেডে উন্নীত হলেও ঝিনাইদহ এক্ষেত্রে পিছিয়ে।

তিনি জানান, প্রতিদিন রোগীর অত্যাধিক চাপে ডাক্তাররা কাহিল হয়ে যাচ্ছেন। জরুরি কয়েকটি বিভাগে দীর্ঘদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় পরিস্থিতি দিনকে দিন ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে ডা. আইয়ব বলেন, “আমাদের প্রমোশন নেই, সুযোগ সুবিধা নেই, পিয়ন নেই। ২৬ বছর সেই একই পদে পড়ে আছি। কিন্তু অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তো আয়েশে দিন কাটান। ”

আবাসিক মেডিকেল অফিসার রাশেদ আল মামুন জানান, হাসপাতালে দীর্ঘদিন থেকে শিশু, নাক কান গলা, চক্ষু ও সবচে প্রয়োজনীয় মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নেই।

তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে ৯টি বিভাগে অন্তত ৪ জন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার। এক্ষেত্রে কেবল গাইনি, সার্জারি, হৃদরোগ, দন্ত ও হাড়জোড় বিভাগে চিকিৎসক আছে বলে জানান।

সদর হাসপাতালে বর্তমান ২৩ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে ৭ জনকে জেলা শহরের বাইরে থেকে ডেপুটেশনে আনা হয়েছে।

তবে স্বাচিপ নেতাদের অনেকেই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না বলে অভিযোগ। ডিউটি ফাঁকি দিয়ে তারা টিভি রুমে বসে থাকেন বলে অভিযোগ। আবার অনেকে বিনা ছুটিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।

আবাসিক মেডিকেল অফিসার রাশেদ আল মামুন জানান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে প্রতিদিন অনেক গরীব রোগীকে বাইরে রেফার্ড করতে হয়। এছাড়া হাসপাতাল থেকে রোগীদের ৪৫ আইটেমের ফ্রি ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে হৃদরোগ, ব্যাথা, গ্যাসষ্ট্রিক, জ্বর, আমাশয় ছাড়া জটিল রোগের কোনো ওষুধ সরবরাহ নেই বলে জানা গেছে।

ঝিনাইদহ বিএমএর সভাপতি প্রবীণ চিকিৎসক ডা. আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, আমরা হাসপাতালে ১শ বেডের জনবল নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে চেষ্টা করেও কাগজপত্রে এ দোষ সে দোষ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
তিনি জানান, এভাবে একটি জেলা সদরের হাসপাতাল চলতে পারে না। রোগীর চাপ ও নানামুখি সংকটে অনেক সময় ডাক্তার ও নার্সদের মন-মানসিকতা ঠিক থাকেন। তাই, প্রায় সময় দুর্ব্যবহার শুনতে হয় রোগীদের।

তিনি জানান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন নাসরিন সুলতানা বাংলানিউজকে জানান, জনবল নিয়োগের জন্য একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে কাগজ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই।

তিনি জানান, ১শ বেডের খাবার ও ওষুধ পাওয়া গেলেও অবকাঠামো, ও জনবল ৫০ শয্যায় রয়ে গেছে। ফলে ১৮ লাখ জনঅধ্যষিত ঝিনাইদহ জেলার মানুষ হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

তিনি আরও জানান, হাসপাতালে যে জনবল আছে তাতে কিছুটা সামলানো যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ পুরন হলে ভালো হতো। তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষার মান ও যন্ত্রপাতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, অক্টেবর ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।