ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৮৩ প্রাইভেট ক্লিনিকের ৬১টি-ই অবৈধ!

মাসুক হৃদয়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৮৩ প্রাইভেট ক্লিনিকের ৬১টি-ই অবৈধ!

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ৮৩টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ৫৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ১৬টি ক্লিনিক ও আটটি ডেন্টাল ক্লিনিক রয়েছে।

এর ৬১টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের-ই কোনো লাইসেন্স নেই।

বাকি ২২ প্রতিষ্ঠানের ১২টি লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছে। এছাড়া আটটি ডেন্টাল ক্লিনিকের মধ্যে পশ্চিম পাইকপাড়ার আয়েশা ডেন্টাল সার্জারি ও টি এ রোডের দি ডেন্টাল কেয়ার ছাড়া বাকি ছয়টি ডেন্টাল ক্লিনিকেরই লাইসেন্স নেই। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এসব অবৈধ প্রাইভেট ক্লিনিকে অপচিকিৎসার কারণে একের পর এক রোগী মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। গত এক বছরে শহরের ক্লিনিকগুলোতে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়াও এসব ক্লিনিকের বিরুদ্ধে সেবার নামে রোগীর সঙ্গে প্রতারণা ও গলাকাটা বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে।

সিভিল সার্জনের কার্যালয় ও স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের নজরদারির অভাবে ক্লিনিক মালিকরা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছেন।

শহরের ক্লিনিকগুলোতে একের পর এক এসব ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ লোক দেখানো একটি তদন্ত কমিটি গঠন ছাড়া আর কিছু করে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, গত এক বছরে শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল লুৎফুল কবির মিয়াদ নামে ১০ বছরের একটি শিশু হাঁটুর ব্যথা ও জ্বর নিয়ে জেলা সদর হাসপাতালের নবজাতক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মনির হোসেনের তত্ত্বাবধানে শহরের জেল রোডে অবস্থিত দি ল্যাব এইড শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়। ওই চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে শিশুটি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

এ ঘটনায় শিশুটির বাবা হুমায়ূন কবির ব্রাহ্মণবাড়িয়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযুক্ত ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ঘটনার পর ওই চিকিৎসকের বিচার দাবিতে শহরে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করা হয়। কিন্তু আজও এ ঘটনার কোনো বিচার হয়নি।
 
একই বছরের ২ আগস্ট রাত ১০টায় শহরের পশ্চিম পাইকপাড়ায় অবস্থিত সেবা ক্লিনিকে টনসিলের অস্ত্রোপচারের পর শরিফা বেগম (৩৬) নামে এক গৃহবধূ মারা যান।

কসবা উপজেলার ডাবিরঘর গ্রামের বাহরাইন প্রবাসী এলেম মিয়ার স্ত্রী শরীফার স্বজনরা জানান, টনসিলের অস্ত্রোপচার করাতে চিকিৎসক আশিকুর রহমানের পরামর্শে ১ আগস্ট তাকে সেবা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। পরদিন রাত ১০টায় ওই ক্লিনিকের মালিক ডা. বজলুর রহমানের উপস্থিতিতে আশিকুর রহমান ও অ্যানেসথেসিস্ট ডা. আব্দুল মান্নান তার টনসিলের অস্ত্রোপচার করেন। এতে সঙ্গে সঙ্গেই শরিফার মৃত্যু হয়।

অবশ্য সেবা ক্লিনিকের মালিক ডা. বজলুর রহমান মৃত্যুর দায় স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, অস্ত্রোপচারকারী অ্যানেসথেসিস্ট ডা. আব্দুল মান্নানের ভুলের কারণেই রোগীর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
এরপর নানা কৌশলে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়।

ওই বছরের ২৮ আগস্ট শহরের মৌলভীপাড়া শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকের অবহেলার কারণে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়। জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার আমিনপুরের বাবুল মিয়ার স্ত্রী হেলেনা বেগম প্রসব ব্যথা নিয়ে ঘটনার চারদিন আগে (২৪ আগস্ট) ওই ক্লিনিকে ভর্তি হন। ক্লিনিকের চিকিৎসক জাকিয়া সুলতানা তার সিজার করেন। এসময় হেলেনা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। নবজাতকটি অপরিণত হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়। ইনকিউবেটরে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাত ৮টার দিকে শিশুটি মারা যায়।

এরপর শিশুটির বাবা বাবুল মিয়া থানায় গিয়ে কান্নাকাটি করলে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এসময় হাসপাতাল এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় এ ঘটনা তদন্ত করতে সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ওই কমিটি এখনো পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। পরে অবশ্য একটি প্রভাবশালী চক্রের মধ্যস্থতায় বিষয়টি মিমাংসা হয়।

এরপর ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর শহরের মুন্সেফপাড়ার হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও সেখানকার এক চিকিৎসকের অবহেলার কারণে তাছলিমা আক্তার (২৫) নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়।

জানা যায়, কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের আলম মিয়ার স্ত্রী তাছলিমা আক্তারকে ২০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়।

স্বজনদের অভিযোগ, বেলা সাড়ে ১২টার পর রোগীকে অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দেন ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ইলিয়াছ আহাম্মদ। রোগীর স্বজনরা এতে রাজি হলে অস্ত্রোপচার শুরু করেন তিনি। এসময় রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার কাজটি করেন হাসপাতালের একজন সেবিকা (নার্স)। পরে বিকেল ৪টায় ড. ইলিয়াছ অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে বেরিয়ে রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান।

২০১৩ সালের ১৬ জুলাই শহরের কুমারশীল মোড়ে অবস্থিত দি ল্যাব এইড শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় শারমিন আক্তার নামে এক প্রসূতি মারা গেছেন।

শারমিন আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের বেহাইর গ্রামের রুহুল আমিনের স্ত্রী। জেলা সদর হাসপাতালের গাইনি, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সার্জন ডা. শরীফ মাসুমা ইসমতের ভুল চিকিৎসায় ওই প্রসূতির মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

পরে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের কয়েকটি কক্ষে ভাঙচুর চালান।

রোগীর স্বজনরা জানান, ১৫ জুলাই সোমবার বিকেলে রোগীকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক শরীফ মাসুমা তাকে অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দেন। অস্ত্রোপচারের পর শারমিন কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এরপর রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক ছিল। পরে মঙ্গলবার সকালে অতিরিক্ত ওষুধ ও ইনজেকশন দেওয়ায় তার অবস্থার অবনতি ঘটে। সকালে চিকিৎসকের সামনেই তার মৃত্যু হয়।
 
রোগীর মৃত্যুর পরপর চিকিৎসক, সেবিকা ও কর্মচারীরা হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন ও রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষ, তিন তলার ওয়ার্ড মাস্টার, সেবিকা, অপারেশন থিয়েটার ও অফিস কক্ষের জানালা ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন।

সবর্শেষ ১৯ জুলাই শুক্রবার দি ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকূট গ্রামের কৃষক হান্নান মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগমের (৩০) কিডনি কেটে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কিডনি থেকে পাথর অপসারণের সময় রোগীর অনুমতি ছাড়াই চিকিৎসক কিডনি কেটে ফেলেন।

ওই হাসপাতালে কর্মরত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন) চিকিৎসক ফোরকান আহমদের তত্ত্বাবধানে এ অস্ত্রোপচার হয়েছিল।

চিকিৎসক ফোরকান আহমদ রোগীর স্বজনদের জানান, পাথর অপসারণ করার সময় রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় কিডনি ফেলে দিতে বাধ্য হন তিনি। স্বজনদের অভিযোগ, অনুমতি ছাড়াই কিডনি কেটে ক্লিনিক মালিক আর চিকিৎসক তা অন্য কোথাও বিক্রি করে দিয়েছেন।

এদিকে, অস্ত্রোপচারের এক সপ্তাহ পর রোগী তার কিডনি কেটে ফেলার বিষয়টি জানতে পারেন। পরে রোগীর স্বজনদের হাতে নগদ এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় শহরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
 
পরে জেলা সদর হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. আমানুল্লাহ আমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
 
এসব বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্লিনিক মালিক সমিতির সভাপতি জিল্লুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ক্লিনিকে রোগী মারা যাওয়ার  বিষয়গুলো স্বাস্থ্য বিভাগ দেখে থাকে। আমাদের মালিক সমিতির কাজের পরিধি এতোটা ব্যাপক নয়। কিন্তু তারপরও কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসতো তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতাম।

ক্লিনিক মালিক সমিতির কাজ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত আমরা অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো দেখে থাকি। তাছাড়া ভিকটিমরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়না।
 
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, লাইসেন্সবিহীন ও লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়া ক্লিনিকগুলোকে আমরা এরই মধ্যে লিখিতভাবে চিঠি দিয়েছি। লাইসেন্সের জন্য আবেদন ও লাইসেন্স নবায়ন না করা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ক্লিনিকগুলোতে অপচিকিৎসায় রোগী মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অপচিকিৎসার শিকার হওয়া কেউ কোনো অভিযোগ দেয়না। ফলে বিষয়টি অধরাই থেকে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৩
এসআই/জেসিকে eic@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।