ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতন হউন

মোঃ আবু জাফর সাদেক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৩
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতন হউন

ঢাকা: থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্ত রোগ যার উপাদান বহন করে শতকরা প্রায় তিন জন। এশিয়া এবং আফ্রিকায় এই রোগের প্রকোপ অন্য মহাদেশের তুলনায় শতকরা দুই ভাগ বেশি।



অনেক ক্ষেত্রেই থ্যালাসেমিয়া তেমন কোন সমস্যা সৃষ্টি না করলেও কিছু ক্ষেত্রে তা প্রাণঘাতী রূপ লাভ করে। তবে আশার কথা হলো থ্যালাসেমিয়ার উন্নত ও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা অত্যন্ত আশাপ্রদ ফল দেয়।

মানুষের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহকারী হিমোগ্লোবিনের জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে। হিমোগ্লোবিনের প্রধান দুটি অংশ হলো আলফা ও বিটা চেইন এবং থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে এই দুটি চেইনের একটিতে বা উভয়টিতে সমস্যা দেখা যায়।

হিমোগ্লোবিন চেইনে সমস্যার কারণে রোগীর শরীরে পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন থাকে না অথবা লোহিত রক্ত কনিকা অতি সহজেই ভেঙ্গে যায়, ফলশ্রুতিতে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় শরীর অতিরিক্ত হারে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের চেষ্টা করে যা পুরো সমস্যাটিকে আরও প্রকট করে তোলে।

প্রকারভেদ: থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই প্রকার, আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। এই দুই থ্যালাসেমিয়াকে আরও কিছু সাব গ্রুপে বিভক্ত করা হয় যা নির্ধারিত হয় রোগের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে। এর বাইরেও আরও কিছু ব্যতিক্রমী থ্যালাসেমিয়া আছে যার প্রকোপ খুবই কম বা তেমন একটা নেই বললেই চলে।

থ্যালাসেমিয়ার সবচেয়ে দুর্বল অবস্থা হলো থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট এবং সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা হলো বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর।

থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট: এই ক্ষেত্রে বাহকের শরীরে থ্যালাসেমিয়া জিন থাকে তবে শরীর পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সক্ষম থাকে বলে তেমন বড় কোন সমস্যা দেখা যায় না। কোন কোন ক্ষেত্রে এই রোগে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট সম্পন্ন ব্যক্তির সাথে অন্য কোন থ্যালাসেমিয়া ট্রেইটের বিবাহ হলে তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট তিন প্রকার, নিচে এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হলোঃ

(ক) আলফাপ্লাস থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট: এই ক্ষেত্রে বাহকের ৪টি আলফা হিমোগ্লোবিন জিনের মধ্যে মাত্র একটিতে সমস্যা থাকে। এই ট্রেইট কেবল মাত্র তখনই সমস্যা সৃষ্টি করে যখন জীবন সঙ্গীর আলফা জিরো থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট থাকে, অন্যথায় তেমন বড় কোন সমস্যা নেই বললেই চলে।

(খ) আলফা জিরো থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট: এই ক্ষেত্রে বাহকের ৪টি হিমোগ্লোবিন জিনের ২টিতে সমস্যা থাকে। এই ট্রেইট কেবল মাত্র তখনই সমস্যা সৃষ্টি করে যখন জীবন সঙ্গীর (স্বামী/স্ত্রী) আলফা জিরো থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট বা আলফা প্লাস থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট থাকে।

(গ) বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট: এই ক্ষেত্রে বাহকের দু’টি বিটা হিমোগ্লোবিন জিনের একটিতে সমস্যা বা অস্বাভাবিকতা থাকে। জীবন সঙ্গীর (স্বামী/স্ত্রী) বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট থাকলে এই ট্রেইটের বাহকের সন্তানদের মারাত্মক থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর: এই ধরনের বাহকের ২টি বিটা থ্যালাসেমিয়া জিন থাকে এবং তাদের হিমোগ্লোবিনের প্রকৃতি অস্বাভাবিক, ফলশ্রুতিতে তা সার্থকভাবে ভাবে কাজ করতে পারে না এবং মারাত্মক এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

বিটা থ্যালাসেমিয়া ইন্টার মেডিয়া: এটি বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজরের চাইতে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক, তবে নিয়মিত চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। এই শ্রেণির বাহকের ২টি থ্যালাসেমিয়া জিন থাকে তবে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন খুব একটা কমে না।

সিকেল সেল/বিটা থ্যালাসেমিয়া: যদি স্বামী বা স্ত্র্রী যে কোন এক জনের বিটা থ্যালাসেমিয়া জিন এবং অন্য জনের সিকেল সেল এনিমিয়া (বিশেষ ধরনের রক্তস্বল্পতা) থাকে তবে সন্তানের বিটা থ্যালাসেমিয়া বা সিকেল সেল থ্যালাসেমিয়া হতে পারে।

এইচবি ডিজিস: এটি এক ধরনের আলফা থ্যালাসেমিয়া যেখানে বাহকের ৪টি আলফা হিমোগ্লোবিন জিনের ৩টিতে সমস্যা থাকে। স্বামী বা স্ত্রী একজনের আলফা প্লাস থ্যালাসেমিয়া ও অন্য জনের আলফা জিরো থ্যালাসেমিয়া থাকলে এইচবি ডিজিস হতে পারে যা অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করে।

এইচবি পার্টস: এটি একটি মারাত্মক রকমের থ্যালাসেমিয়া যেখানে বাহকের ৪টি আলফা হিমোগ্লোবিন জিনের ৪টি’ই সমস্যা যুক্ত। সাধারণত এ রোগের ক্ষেত্রে শিশুরা মায়ের পেটেই রক্তস্বল্পতায় মারা যায়।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ সমূহ: অনেক ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না তবে বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, ফ্যাকাসে শরীর, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শরীর অবশ মনে হওয়া, অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, জন্ডিস, ঘোলা প্রস্রাব প্রভৃতি হতে পারে।

থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা: রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।

থ্যালাসেমিয়ার সম্ভাবনা: বাবা-মা উভয়ের বিটা থ্যালাসেমিয়া থাকলে তাদের প্রতি ৪ সন্তানের একজনের স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন/বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট/বিটা থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমেডিয়া হতে পারে। এর সঙ্গে প্রতি ২জন সন্তানের ১ জনের থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট থাকতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া থেকে মুক্তির উপায়: বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রীর রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে তাদের মধ্যে বিবাহ হলে আগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যাদের থ্যালাসেমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট আছে তাদের উচিৎ সাধারণ বা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট মুক্ত কাউকে বিয়ে করা।

প্রয়োজনে পাত্র-পাত্রীর রক্ত পরীক্ষার ফলাফল দেখিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই থ্যালাসেমিয়া/থ্যালাসেমিয়া ট্রেইটের সাথে ঐ একই ধরনের বাহকের বিবাহ নিরুৎসাহিত বা নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে যা বেশ ইতিবাচক ফলাফল দেয়।

লেখক: মোঃ আবু জাফর সাদেক, ফার্মাসিস্ট ও সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজার, রেনাটা লিমিটেড।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৩
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর (অ্যাক্ট.)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।