ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

চাই হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার!

মাহমুদ মেনন ও মাজেদুল নয়ন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৪
চাই হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার! ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিশেষত্বই হচ্ছে কোথাও কোনো রোগী একটু সিরিয়াস হলেই তাদের শেষ ভরসার স্থল হয়ে উঠছে এই ইউনিট। আর এর একটি অদ্ভুত দিকও রয়েছে।

আমরা দেখছি, যখন অন্য হাসপাতালের চিকিৎসকরা কোনো রোগী নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে যান, মনে করেন হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে না, তখন তারা দ্রুত রোগীটিকে ঢামেক বার্ন ইউনিটে রেফার করেন। পেরিফেরির হাসপাতালগুলো, ক্লিনিকগুলো কোনো সুযোগ নিতে চায় না। আর সে কারণেই ঢাকা মেডিকেলের ওপর চাপ একটু বেশি।

কথাগুলো বলছিলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান। ১৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার ঢামেকের কনফারেন্স হলে বাংলানিউজের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বিস্তারিত কথা বলেন তিনি।
 
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে রয়েছেন অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক সাজ্জাদ, অধ্যাপক শাহরিয়ারের মতো সেরা বিশেষজ্ঞ। এরা চারজনই বার্ন অ্যান্ড প্ল্যাস্টিক সার্জারিতে বাংলাদেশের অত্যন্ত নামকরা চিকিৎসক। রোগীর অবস্থা জটিল হলে তাদের কাছে পাঠানো হবে এটাই স্বাভাবিক।  

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজ বলেন, সারা দেশে ১২টি সরকারি হাসপাতালে এখন বার্ন ইউনিট রয়েছে। সেখানে চিকিৎসাও চলছে। তবে যারা চালাচ্ছেন তারা এই বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদেরই শিক্ষার্থী। আর সে কারণে যখনই কোনো জটিল বা গুরুতর রোগী পাচ্ছেন তারা পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাদের শিক্ষকদের কাছে।

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট কতটা আধুনিক, কতটা যুগোপযোগী, কতটা সেবা নিশ্চিত করা এখানে সম্ভব? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বার্ন ইউনিটে যাতে কাউকে কোনো কিছুই কিনতে না হয় সে লক্ষ্যে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি বার্ন ইউনিট ঘুরে দেখার সময় তিনি এই নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা দেবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন।

তবে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও এ পর্যন্ত ঢামেক বার্ন ইউনিট কোনো চাহিদা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায় নি উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কিছু কিছু অনুদান আসছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। এগুলো সরাসরি রোগীদের পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বার্ন ইউনিটের ইন্টারনাল রিসোর্স যা রয়েছে তাতেই এ পর্যন্ত রোগীদের সেবায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে কিছু জমা অর্থ দিয়ে বার্ন ইউনিটটিকে আরও আধুনিক করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন তিনি।

‘বার্ন ইউনিট ঘুরে দেখলে এর ওয়ার্ডগুলোকে কোনোভাবেই আধুনিক বলা যাবে না। আপনার কি মনে হয়?’- বাংলানিউজের এমন প্রশ্নে আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে সেকেলে বিডিং পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দিতে হবে এই নিয়মের ফাঁদে আটকে থাকি আমরা। আমাদের হাতে টাকা থাকলেও ভালো মানের, বেশি দামের সরঞ্জাম কেনা সম্ভব হয় না। ’

‘রোগীর খাট কিনতে দরপত্র চাওয়া হলে কেউ একজন ৫ হাজার টাকা দর দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ভালো কোম্পানির ভালো একটি খাটের দাম এর চেয়ে অনেক বেশি। দর বেশি হওয়ার কারণে সেটা কেনা সম্ভব হচ্ছে না, কিনতে হচ্ছে কমদামি খাট। ’

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কিনে ফেলাটি সমস্যা নয়। সমস্যা অডিটরদের বোঝানো। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। আর যার তত্ত্বাবধানের কাজগুলো থাকে তার সময় কোনো অডিট আপত্তি থাকলে পেনশন পর্যন্ত আটকে যায়। আর এ কারণে নিজের ক্ষতি ডেকে আনতে কেউ চায় না।

ঢাকা মেডিকেলের চারজন উপ-পরিচালক এ সমস্যায় পড়েছেন। তাদের একজন মৃত্যুবরণও করেছেন। কিন্তু তাদের পেনশন নিয়ে নানা সমস্যা কাটেনি এমন তথ্য দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্রেফ অডিট আপত্তির কারণেই তাদের এমন বিপাকে পড়তে হয়েছে।

এখানে বিষয়টি পণ্যের গুনগত মানের। একই পণ্যের গুনগত মানে বড় ধরনের তারতম্য থাকে। ফলে কিনে ফেললে বিপদে পড়তে হয়, বলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজ।  

আরও খোলাসা করার লক্ষ্যে তিনি বলেন, ভালো ব্র্যান্ডের ব্যান্ডেজ একটির দাম ২০০টাকা। সেখানে অন্য কম দামি ব্যান্ডেজ দেড়শ’ টাকায় মিলছে ৬টি। ঢামেককে বাধ্য হয়ে ওইগুলোই কিনতে হচ্ছে। ফলে ব্যান্ডেজ ব্যবহারের পর একটু নড়াচড়া করলেই তা খুলে যাচ্ছে। আর তাতে প্রশ্ন উঠছে হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে। আর চিকিৎসকেরও সময় নষ্ট হচ্ছে অনেক বেশি। যতবারই খুলে যাচ্ছে তাকে নতুন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে হচ্ছে।
 
সর্বনিম্ন দরের সঙ্গে পণ্যের মানটিকে কেনো গুরুত্ব দেওয়া যাচ্ছে না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন কমিটি চাইলে সেটি হয়তো সম্ভব। কিন্তু দায়বদ্ধতাটি তাদের নয়, দায়বদ্ধ হতে হয় কর্তৃপক্ষকে, পরিচালক, উপ-পরিচালকদের। তাদেরকেই অডিট আপত্তি ফেস করতে হয়। ফলে মান বাড়ানো সম্ভব হয় না। আর এখানে একটি দুর্নীতির বিষয়ও থাকে। অডিটদের কাছেই আমাদের বাঁধা পড়ে থাকতে হয়।

‘দুর্নীতির বিষয়টি একটু স্পষ্ট করবেন কি?’-- এমন প্রশ্নে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুর্নীতিতে দেশটিই ভরে গেছে। আমরা জানি, ফাইন্যান্সিয়াল মিস ম্যানেজমেন্ট হলে পুরে অর্গানাইজেশনেই মিস ম্যানেজমেন্ট সৃষ্টি হয়। যারা অডিট করতে আসেন তাদের ঘুষ না দিলে কোনো কাজই করতে চান না। আর কোথাও কোনো সামান্য আপত্তি দেখলেও সেটিকে তারা বড় করে তোলেন।

আপনি মান বাড়াতে একটি কাজ করেছেন নাকি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু করেছেন, তা তাদের কাছে দেখার বিষয় থাকে না। কোথায় কাকে কিভাবে আটকে দিয়ে টু-পাইস নিশ্চিত করতে পারবেন সেই চেষ্টায় থাকেন। তখন তারা আইন-কানুন দেখাতে ব্যস্ত থাকেন। আর ঘুষ পেলেই তারা আবার সেটি এড়িয়ে যান, অভিযোগ মোস্তাফিজুর রহমানের।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ কর্মী যথেষ্টই রয়েছে, এই ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই বলে দাবি এই পরিচালকের। তিনি বলেন, এখানে যথেষ্ট উন্নত মানের ঔষধও রয়েছে। এখানে প্রধান সীমাবদ্ধতা পরিবেশের। হাসপাতালে চিকিৎসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বার্নের একজন গুরুতর রোগীকে যখন মেঝেতে থাকতে দেওয়া হয় তখন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের ভীষণ খারাপ লাগে। বার্ন থেকে ইনফেকশন হয়ে যায়। কিন্তু রোগীকে সেই সুষ্ঠু পরিবেশ দেওয়াই সম্ভব হচ্ছে না।

এজন্য অবশ্য রোগীদের স্বজনদেরও দায়ী করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুস্তাফিজ। তিনি বলেন, একজন রোগীর সঙ্গে চারজন এসে ঘিরে থাকবেন, যেখানে একজন উপস্থিত থাকলেই চলে। এই সচেতনতার অভাবটিও একটি বড় সমস্যা।

তিনি বলেন, ‘এমনও দেখেছি আনসারদেরও ওপর চড়াও হচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। ঢাকা মেডিকেলে এলেই যার যত গুন্ডামি আছে সব দেখা যায়। ’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে রোগীর স্বজনদের প্রতি আহ্বান জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান।

প্রযুক্তির দিক দিয়ে ঢামেক বার্ন ইউনিট আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি। আর দক্ষতায় এখানকার চিকিৎসকরা অনেক বেশি এগিয়ে এমন দাবি করে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। ওইসব দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে চিকিৎসকরা বাংলাদেশে আসেন। এর কারণ হচ্ছে তারা এত রোগী কখনোই পান না। এছাড়া এত ক্রিটিক্যাল অবস্থার, বিভিন্ন ধরনের রোগীও সাধারণত বিদেশে পাওয়া যায় না।

এখানে আমাদের সমস্যাই হচ্ছে আমরা একটি ভালো বিছানা দিতে পারছি না। ভালো একটি পরিবেশ দিতে পারছি না। সেটা পারলেই আর কোনো অসুবিধা ছিলো না, বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

এখানে একটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে উল্লেখ করে মোস্তাফিজ বলেন, দেয়ালে সামান্য রং করাতে হলেও অন্য ডিপার্টমেন্টের শরণাপন্ন হতে হয়। ফলে কাজগুলো ঝুলে যায়।

তিনি বলেন, বার্ন ইউনিটটি এখনও একটি প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত। সরকারের রাজস্ব বিভাগের আওতায় না আসার কারণে এখানে অর্থ বরাদ্দ যেমন কম তার চেয়েও বড় সঙ্কট স্বল্প জনবল। বার্ন ইউনিটের সব উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে মেডিকেল কলেজ থেকে। তবে সেটাও করছি ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। এগুলোর কারণে যেকোনো সময়ে অডিট আপত্তি হয়ে বসতে পারে। আর একবার তা হলে তা আর সমাধান করা সম্ভব হবে না।

বিষয়টি স্পর্শকাতর বলেই হয়তো কেউ প্রশ্ন তুলছে না। কিন্তু প্রশ্ন তুললে আমরা কোনো জবাব দিতেও পারবো না, বলেন মোস্তাফিজ।

তিনি বলেন, এখানে প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে অনেক কিছুই করা সম্ভব হবে না। ফলে ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়। একজন পেশেন্টকে যখন ভর্তি করে নেই তাকে মেঝেতে রাখলেও খাবার-ঔষধ সঠিকভাবে দেওয়ার চেষ্টা করি। আপত্তি আসে যতগুলো বেড তার চেয়ে বেশি খাবার কেনো? আমার উত্তর যে বেড পাচ্ছে সে খাবার-ওষুধ সব পাবে। আর যে বেড পায়নি সে অন্য সুবিধাও পাবে না এমন বৈষম্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হতে দেওয়া যায় না। আর এটা ঊর্ধ্বতনদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।

ঢাকা মেডিকেলে বেডের চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হলে তার একটি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। আমরা কেউ চাই না তেমনটি হোক।

বাইরের বার্ন ইউনিটগুলো আরও আধুনিক ও চিকিৎসকদের আরও দক্ষ করে তোলার ওপর জোর দেন মোস্তাফিজুর রহমান। আর বার্ন ইউনিটটি যখন পুরোপুরি একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে কাজ করতে পারবে তখন যে মানবসম্পদ তৈরি হবে তা দিয়েই ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক পাঠানো সম্ভব হবে, অভিমত তার।

তবে এসব কিছুর চেয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে মানবসম্পদের সঙ্কট। লোকবলের সঙ্কটই বার্ন ইউনিটের বার্নিং ইস্যু বলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে প্রকল্পে ৫৬ জন লোক নিয়োগ করা হয়। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। অধিকাংশই সরকারি চাকরিতে ঢুকে গেছেন। এই মানুষগুলোকে সরকারের রাজস্ববিভাগের আওতায় নেওয়া যাচ্ছে না বলেই এত ভোগান্তি।

যারা বিশেষ ব্যবস্থায় কাজ করছেন তারা রোগীদের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছেন। কারণ তাদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ৩৩ জন কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন যারা একটি টাকাও সরকারি খাত থেকে পাচ্ছেন না। ফলে তারা রোগীর কাছ থেকে যতটুকু আদায় করে নিতে পারছেন তাই তাদের আয়।

বিষয়টি বিভিন্ন পর্যায়ে তোলা হয়েছে, মন্ত্রী ও সচিবরা এ বিষয়ে একমতও কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচ রয়েছে। প্রকল্পের সময় সীমা শেষ হওয়ার আগে তা রাজস্ববিভাগে পাঠানো যাবে না। এরপর প্রকল্প যদি আরও পাঁচ বছরের জন্য বর্ধিত হয় তাহলে প্রক্রিয়াটি আবারও আটকে যাবে।

বিশেষ আদেশ দিয়ে কাজটি হয়তো করা সম্ভব কিন্তু কেউ সেই বাড়তি দায়বদ্ধতা বা দায়িত্বটি নিতে চায় না, বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

বার্ন ইউনিট নিয়ে এখন যত আলোচনা হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হলে তা আর থাকবে না। তখন আর কেউ খবরও রাখবে না বলে মত দেন ঢামেক পরিচালক। তিনি বলেন,  স্বাভাবিক সময়েও এখানে ৩৫০ থেকে ৪০০ রোগী থাকেন। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার রোগীর সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ৩২ জন জানিয়ে তিনি বলেন, বাকি সব পেসেন্টই সাধারণ দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।  

লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি একটি হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার (এইচওসি) স্থাপন অত্যন্ত জরুরি বলে জানান মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এটি এমন একটি চেম্বার যাতে রোগীকে ঢুকিয়ে দিয়ে তার শ্বাস নিতে আর কোনো কষ্ট হয় না। এটা খুবই দরকার। রোগীদের বেরিয়ার নার্সিং করার জন্য ইউনিটটি হওয়া প্রয়োজন বড় কাচের ঘরের ভেতর। স্বজনরা যারা দেখতে চান তারা যেনো বাইরে থেকে দেখতে পারেন। এতে ওয়ার্ডের ভেতরে চাপ কমবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা।

একজন গুরুতরভাবে পুড়ে যাওয়া রোগীর জন্য একজন নার্স থাকা প্রয়োজন। সেখানে ৭০-৮০ জন রোগীকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে মাত্র দুই জন নার্স। এতে সেবার মান সহজেই অনুধাবন করা যায়। ম্যান পাওয়ারের সমস্যাই আমরা বেশি ফেস করছি, বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।  

অতীতে পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাস খানেক আগে সরকার ৫ হাজার নার্স নিয়োগ দেয়। এর মধ্য থেকে ঢাকা মেডিকেলে ৪০ জন নার্স দেওয়া হযেছে। এতে অন্তত সার্বক্ষণিক ২/৩ জন করে নার্স ওয়ার্ডে রাখা সম্ভব হচ্ছে। আগে থাকতেন মাত্র একজন।

নার্স ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগীদের কিংবা তাদের স্বজনদের অভিযোগগুলোর সত্যতাও অকপটে স্বীকার করে নিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, তারা সময় দিতে চান না। আর হাসি কারো মুখেই নেই।

তবে চাপের কারণেই তাদের মুখের হাসি চলে যায় বলে মত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজের। তিনি বলেন, ৭০-৮০ জন রোগীর সেবা করতে গিয়ে তারা আসলে কারো সেবাই করতে পারেন না। তাদের নিজেদেরও একটা মন ও বিবেক রয়েছে। তারা জানেন তাদের কি করার কথা। কিন্তু সীমাবদ্ধতাগুলো তাদের কষ্টই দেয়। কাউকে সাহায্য করতে না পারারও একটি কষ্ট আছে।

একজন অধ্যাপক চিকিৎসক দিনে ১০ জনের বেশি রোগী দেখতে পারার কথা নয়, কিন্তু তাকে দেখতে হচ্ছে ২০০ রোগী। ফলে মানসম্মত সময় রোগীকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা ওয়ার্ডে রোগীর পাশ থেকে ঘুরে যাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেন না। অনেকটা পিলো পাসিংয়ের মতো ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু রোগী চায় চিকিৎসক তার পাশে একটু দাঁড়ান, গায়ে হাত দিয়ে দুটি কথা বলুন। কিন্তু সেটা হয় না। আর সম্ভবও না এই কারণে, একজনকে সময় দিতে গেলে চোখের দেখাটিও দেখা হবে না আরও ৯০ জনের সঙ্গে। তারা বঞ্চিত হবে।

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসায় ভালো করা না গেলে বিশ্বের অন্য কোনো হাসপাতালেও তাকে ভালো করা যাবে না, এমন কথা দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ জন পোড়া রোগীকে ঢাকা মেডিকেল থেকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের পাঁচ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। শরীরের ৪০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে রোগীদের বাঁচানো দায়। আবার ৪০ শতাংশের নিচে হলেও, শ্বাসনালী যদি পুড়ে যায় সে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। আগুনের মধ্যে পড়ে মানুষ ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে যখনই শ্বাস নিতে থাকে তখন শ্বাসনালী পুড়ে যায়। আর এ কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এদের দেশের বাইরে নিয়েও কোনো উপকার পাওয়া যায় না।

ঢাকার বাইরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটগুলোকেও একই সঙ্গে আধুনিক ও সমৃদ্ধ করতে হবে বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তবে ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোতে ছোট ঘটনায় অনেক বেশি ঝামেলা হয়। সেখানে চিকিৎসকরাও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তারা মনে করেন রোগী মারা গেলেই হামলা হতে পারে। মারামারি, ভাংচুর শুরু হতে পারে। আর সেটা এড়াতেই তারা উন্নত চিকিৎসার নাম করে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন। এটিও একটি বাস্তবতা।

তবে দায়িত্ব এড়ানোর জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ বুঝতে পারে না এটা সত্য কিন্তু তাই বলে চিকিৎসক তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এখানে প্রয়োজন একটি দায়িত্বশীলতা। কারণ এই চিকিৎসকরা বাইরে প্র্যাকটিস করে বাড়তি অর্থ আয় করছেন। আর একারণে কিন্তু তারা খুব বেশি দূর এগোতে পারেন না।

কিন্তু যারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন, তারা ঠিকই নাম করেন। তাদের নাম লোকের মুখে মুখে শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আজিজুল কাহহার, অধ্যাপক দ্বীন মোহাম্মদের মত যোগ্য ও জনপ্রিয় চিকিৎসকের নাম উচ্চারণ করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, তাদের নাম এমনি এমনি হয়নি। দ্বীন মোহাম্মদ কোনো রোগীর কথা শুনলে সেখানে ছুটে যাবেনই। রাত সাড়ে তিনটা-চারটায়ও আজিজুল কাহহারকে ডাকা হলে ছুটে আসেন হাসপাতালে। আর সে কারণেই তাদের এত নাম ডাক।

একজন ভালো চিকিৎসকের পাশাপাশি একজন ভালো মানুষও হতে হবে, মত দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগে একজন ভালো মানুষ হতে হবে, তারপরেই হতে হবে ভালো চিকিৎসক।

ইট-পাথরের ডাক্তার হয়ে এফআরসিএস করে কোনো লাভ নেই। এর চেয়ে টোটকা ডাক্তার যিনি মাথায় হাত দিয়ে রোগীর খোঁজ-খবর নিয়ে চিকিৎসা দেন তাদের কাছেই মানুষ বেশি যাবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভালো দিকটি হচ্ছে এখানে ইট-পাথরের ডাক্তার কম। আর রোগীর স্বজনদের রয়েছে অবাধ বিচরণ। ফলে এখানেই মানুষ ছুটে আসে। আমরা তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা ও সেবা দিতে প্রস্তুত, বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

বাংলাদেশ সময় ১০২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৩
এমএমকে/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।