ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

রোগীর হাতে মানসিক হাসপাতালের চাবি!

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৪
রোগীর হাতে মানসিক হাসপাতালের চাবি! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: পুরুষ ওয়ার্ডের কলাপসিবল গেট ধরে আছে ৩০-৩৫ বছরের এক যুবক। হাতে গেটের তালার চাবি।

সামনে দাঁড়াতেই বললেন, আসবেন?

 উত্তর দিলাম: না। আপনার নাম কী?

বললেন, জাহিদুল ইসলাম জীবন। বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি এখানকার গেটের দায়িত্বে রয়েছেন?
-    না, আমি এখানকার রোগী।
-    কতদিন ধরে আছেন?
-    - দেড় মাস হয়েছে।

গেটের চাবি আপনাকে কে দিয়েছে?
- এটা আমার কাছেই থাকে। আপনি ভেতরে আসেন।

রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত ২শ’ শয্যার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে শনিবার এমনই চিত্র ধরা পড়েছে। মানসিক রোগীরাই যেন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন নিজেদের দায়িত্ব।

শনিবার দুপুরে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার পুরুষ ওয়ার্ডে দেখা যায়, মানসিক রোগী পালন করছেন নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব।

এই ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা ৩৩ জন। এর মধ্যে বয়স্কদের সঙ্গে রাখা হয়েছে শিশুদেরও। ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, চার জন রোগী রয়েছে, যাদের বয়স ১৬ বছরের কম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বয়স্ক মানসিক রোগীর সঙ্গে শিশু রোগীদের রাখা নিয়মবহির্ভূত । কারণ এতে শিশুদের যৌন হয়রানির ঝুঁকি থাকে।

তৃতীয় তলায় নারী ওয়ার্ডের গেটে কাউকে দেখা যায় নি। কলাপসিবল গেট খুলে, ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। দুজন নার্স ব্যস্ত দাপ্তরিক কাজে। রোগীদের সামলাচ্ছেন স্বজনরা।
Mental_hospital_Reporter
বের হওয়ার সময় ঘটলো বিপত্তি। গেটে তালা! আরো দুজন দর্শনার্থীও জমে গেছেন। গেট ধরে আওয়াজ করার কিছুক্ষণ পর এক নারী এগিয়ে এলেন চাবি নিয়ে।

গেট খুলে দেয়ার পর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, এখানে আমার ছোট বোন আছে, দুই মাস ধরে। চাবি আপনার কাছে কেন?

- লোক নাই। তাই এই কাজটা আমি করতেছি। অন্য সময় অন্য কেউ করেন।

হাসপাতালের চতুর্থ তলায় মাদকাসক্তদের জন্যে পৃথক ৫০ শয্যার ওয়ার্ড। তবে এখানে রয়েছে মানসিক রোগীরাও।

ওয়ার্ডের তালা খুলে দিলেন একজন নার্স। জানতে চাইলাম, আপনাকে কেন গেট খুলতে হচ্ছে? বললেন, লোক নেই। একজন ওয়ার্ডবয় গেটের দায়িত্ব পালন করে। এখন হয়তো অন্য কাজে রয়েছে। তাই আমি করছি।
Mental_hospital_Re
এভাবেই ভারসাম্যহীনভাবে চলছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রহরী, ওয়ার্ডবয় এবং নার্স।

সকালে দেখা যায়, পুরুষ ওয়ার্ডে নার্সের সংখ্যা দুই জন। কর্তব্যরত একজন নার্স বললেন, সকালে থাকি দুজন। দুপুর এবং বিকেলের শিফটে একজন করে নার্স থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মচারী জানান, রোগীদের প্রহরায় রাখা হয় না বলে প্রায়শই রোগী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, স্যাঁতস্যাঁতে ও দুর্গন্ধময় পরিবেশ। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা দিনে মাত্র দু’বার এসে পরিষ্কার করে যান ওয়ার্ড।
বাথরুমগুলোও নোংরা। সেগুলোতে সুস্থ মানুষের যাওয়ার মত কোনো অবস্থা নেই।
 
একজন রোগীর স্বজন জানালেন, এখানে এলে রোগী মানসিকভাবে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনরাও অসুস্থ হয়ে যায় পরিবেশের কারণে।

তিনি বলেন, ওয়ার্ডগুলোতে বয় এবং প্রহরীর অভাবে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়। প্রায়ই মানসিক রোগীরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে। তখন আমরা স্বজনরাই তাদের সামাল দিই। নার্সরা সাহায্য করে, কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। তারাও বিপদের মধ্যে কাজ করে।
Mental_hospital
হাসপাতালে রয়েছে ছয়টি বিভাগ। এডাল্ট, চাইল্ড, জেরিয়াট্রিক, কমিউনিটি, ফরেনসিক এবং সাইকোথেরাপিক। তবে ওয়ার্ড পৃথক করা রয়েছে শুধু নারী ও পুরুষ ভেদে।

মানসিক হাসপাতালও রক্ষা পায় নি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিটিভদের হাত থেকে। সকালেই দেখা যায়, বহির্বিভাগে রোগী এবং স্বজনদের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলছেন তারা। তাদের কোম্পানির ওষুধ চিকিৎসকরা  পেসক্রাইব করছেন কি না তার ‘তদন্ত’ করছেন রিপ্রেজেনটিটিভরা। ফ্রি-স্টাইলেই চলছে রিপ্রেজেন্টিটিভদের এহেন দৌরাত্ম্য ও অবাধ বিচরণ।

হাসপাতালের সমস্যার ব্যাপারে জনবল সংকটকেই দায়ী করলেন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটি হাসপাতাল ছাড়াও ইনস্টিটিউট। অথচ এখানে লোকবলের সংকট রয়েছে। বরাদ্দকৃত লোকজন রয়েছে, তবে তাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় সামলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, এখানে ছয় ধরনের ওয়ার্ড থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে শিশুদের ওয়ার্ড পৃথক করা জরুরি। তবে আমাদের পক্ষে সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে চিকিৎসক সংখ্যা ৩০ জন। এর মধ্যে ২০ জনই অধ্যাপক। তবে শয্যা ও রোগীর তুলনায় নার্স ও বয়ের সংখ্যা কম। শিফট করে ডিউটি করাতে অনেক সময় একটি ওয়ার্ডে একজনের বেশি নার্স থাকে না। আর বয় একজন করেই থাকার কথা।
hospital_Reporterhospital_Reporter
ওয়াজিউল আলম বলেন, মানসিক রোগীরা হাসপাতালের পরিবেশও নোংরা করে বেশি। অথচ আমাদের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংকট রয়েছে। ১২ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী শিফট অনুযায়ী ডিউটি করে। নাইট ডিউটি, ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে কোনদিন ছয় থেকে আট জনের বেশি পাওয়া যায় না।
 
তবে নতুন করে ৩৪০ জন লোকবল নিয়োগের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান পরিচালক।

রোগী পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, মাঝে মাঝে এমনটি হয়। অনেক সময় ওয়ার্ড বয়রা আশপাশে গেলে এই ফাঁকে এমনটি ঘটে।

তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী একজন মানসিক রোগীর সঙ্গে একজন অ্যাটেনডেন্ট(স্বজন)থাকার কথা। কিন্তু আমাদের এখানে যেসব রোগী আসে, অনেকেরই কিছুদিন পর থেকে কোনো অ্যাটেনডেন্ট থাকে না। ফলে নার্সদের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে।

ভর্তিকৃত রোগীদের ৪০শতাংশকেই ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হয় বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।