মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে: ডাক্তার, নার্স আর চিকিৎসা উপকরণের দাবি পূরণ না হলেও দ্বীপ মনপুরার পাঁচ লাখোধিক মানুষের ভাগ্যে জুটেছে ৫০ শয্যার হাসপাতাল ভবন। প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই হাসপাতাল ভবন ঘটা করে উদ্বোধন হয়েছে আড়াই মাস আগে।
ভোলার দ্বীপ মনপুরা উপজেলা সদরের এই হাসপাতাল সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নতুন ভবনের পাশে পুরোনো ভবনে রোগীরা ছুটে আসছেন দূর-দূরান্ত থেকে। কিন্তু এখানে সর্বত্রই সংকট। ডাক্তারের ১৮টি পদ শূন্য, ১৬ নার্সের মধ্যে আছে ১৪ জন। তৃতীয় শ্রেণীর ৪৭ পদেও মধ্যে আছে ১৭ জন। চতুর্থ শ্রেণীর ৩০ পদের মধ্যে আছে মাত্র ১৬ জন। এক্সরে, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন অকেজো। সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুনীল চন্দ্র বাংলানিউজকে বলেন, ৫০ শয্যার নতুন হাসপাতাল চালুর দাপ্তরিক কোনো নির্দেশনা নেই। মন্ত্রীর এলাকা সফরের কর্মসূচি সামনে রেখে হাসপাতালের ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে। নতুন হাসপাতাল চালু করতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা, ল্যাবরেটরি সুবিধা, ব্লাড ব্যাংক সুবিধা ও জনবল নিয়োগ করতে হবে। বর্তমানে যে ব্যবস্থা আছে, তা দিয়ে ৩১ শয্যার হাসপাতাল চালানোই কঠিন।
তবে ৫০ শয্যার হাসপাতাল উদ্বোধনের খবর এলাকার মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। তারা মনে করেছিলেন, চিকিৎসাক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায় ডুবে থাকা এই এলাকার মানুষ পাবে যথাযথ সেবা। আর সে কারণেই চলতি বছরের ২১ জুন হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংকট নিরসনের দাবি তুলে ধরা হয়। কিন্তু এতদিনেও সেসব দাবি পূরণ না হওয়ায় মনপুরাবাসী হতাশ। ২০০৯ সালে নতুন হাসপাতাল ভবনের কাজ শুরু হয়েছিল।
![](files/September_2014/September_09/upokul__1_258739463.jpg)
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, উপজেলা হাসপাতাল থেকে ভালো সেবা পাওয়ার প্রতীক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। এই ডিজিটাল যুগেও দ্বীপ ও চরাঞ্চলের মানুষ সেই সেকেলে সেবা নিয়ে বেঁচে আছেন। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে বিপদাপন্ন মায়েরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবতীর্ণ হন। নিয়তির উপর ভর করেই বেঁচে থাকেন তারা। এছাড়া অন্য মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচানোও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
মনপুরার বিচ্ছিন্ন চর থেকে বহু রোগী উপজেলা হাসপাতালে এসে যথাযথ সেবা পায় না বলে এলাকার বহু মানুষ অভিযোগ করেছেন। উচ্চমূল্যের কোনো ওষুধ হাসপাতালে পাওয়া যায় না। জেলা সদর থেকে উপজেলা সদর পর্যন্ত ওষুধপত্র পৌঁছাতেও রয়েছে নানান সমস্যা।
এতো গেল উপজেলা সদরের কথা, বিচ্ছিন্ন চরের স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই নাজুক। মাত্র ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা থাকলেও মনপুরার চিত্র পুরোপুরি উল্টো। বিচ্ছিন্ন চর কলাতলীতে ২০ হাজারের বেশি মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, তাতে আবার সেভাবে সেবা নেই।
![](files/September_2014/September_09/upokul__2_774372221.jpg)
লোকবল আর ক্লিনিক সংকটের কথা স্বীকার করেছে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, উপজেলায় ৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। আরও ১১টি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে অ্যাসিসট্যান্ট হেলথ ইন্সপেক্টর থাকার কথা থাকলেও একজনও নেই। এরা টিকাদানসহ অন্য কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এদের কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন হেলথ অ্যাসিসট্যান্টরা। প্রত্যেক ইউনিয়নে ৩-৪ জন করে হেলথ অ্যাসিসট্যান্ট থাকার কথা থাকলেও গোটা উপজেলায় আছে মাত্র ৯ জন।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, হাসপাতালের একটিমাত্র অ্যাম্বুলেন্স বিকল হয়ে আছে দীর্ঘদিন। ব্লাড ব্যাংক নেই। এক্স-রে মেশিন অকেজো, লোকবলও নেই। ল্যাবরেটরি না থাকায় জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া যেসব রোগী দেখা সম্ভব হয়, শুধু তাদেরকেই সেবা দেওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের পাঠানো হয় জেলা সদরে। এভাবে মাসে অন্তত ৩০-৪০ রোগী বাইরে চিকিৎসা সেবার জন্য পাঠানো হয়।
বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। রোগী ভর্তি করা হলেও গরমে রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ফলে অধিকাংশ সময় হাসপাতালের বেড খালি পড়ে থাকে।
![](files/September_2014/September_09/upokul_3_742615204.jpg)
হাসপাতালের প্রধান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে এখানে লোকবল দেওয়া হলেও তারা যোগদানের আগেই বদলির আবেদন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালে এ পর্যন্ত যোগদানকারী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে বছর পার করেছেন খুব কম সংখ্যক কর্তকর্তা। এই সমস্যা সমাধানে বর্তমানে দায়িত্বরত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুনীল চন্দ্র দাস ডাক্তারদের জন্য ঝুঁকিভাতার দাবি তুলেছেন।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com]
বাংলাদেশ সময়: ০২৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৪