ঢাকা: বয়স ২৮ বছর শুনেই চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে ‘হাই রিস্ক মাদার’ লিখে চিহ্নিত করেন শায়লা রহমানকে (ছদ্মনাম)। প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মাস্টার্স পাস করে বিসিএস দিয়ে সবেমাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছি।
জবাবে চিকিৎসক বলেন, ‘আপনার বয়সের কারণেই আপনি এখন ঝুঁকিপূর্ণ মা’।
রাজধানীর মালিবাগের রাহেলা সিদ্দিকী (ছদ্মনাম) পেশায় ব্যাংকের কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের জুন মাসে ৩১ বছর বয়সে তিনি প্রথমবার গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দুই মাসের মাথায় তার গর্ভপাত হয়ে যায়। এরপর ২০১৬ সালে আবারো গর্ভপাত হয় রাহেলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি বয়সে গর্ভধারণেই বাড়ছে এই ঝুঁকি। ২৮ বছর বয়সের পর থেকেই মেয়েদের প্রথমবার মা হওয়ার ক্ষেত্রে এ সমস্যা তৈরি হচ্ছে। শুধু গর্ভপাতের ঝুঁকি নয়, সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে এবং সন্তানের স্বাভাবিকতার ক্ষেত্রেও ঝুঁকিতে পড়ছেন মায়েরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি ও অবস্টাকল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বাংলানিউজকে বলেন, নগরায়নের প্রভাবে এই সমস্যা বাড়ছে। অনেক মা’কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করলে তারা সেটি সহজে মেনে নিতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ২৮ বছরের বেশি বয়স হলেই মেয়েদের প্রথম সন্তান গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি হয়। ৩০ বছরের বেশি হয়ে গেলে এ ঝুঁকি আরো বাড়ে। ৩৫ বছরের বেশি বয়স হয়ে গেলে প্রথম সন্তান জন্মদান অনেক বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। এ সময় স্বাভাবিকভাবেই শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পায়। যেটি গর্ভধারণের জন্যে খুবই বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়।
শুধু সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেই নয়, সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের প্রশ্নটিও ওঠে অতি বয়সে মা হতে গেলে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহীন আখতার বলেন, অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে অনুমাণ করা যায়, জিনগত কারনেই সন্তানের অটিজম সমস্যা হয়ে থাকে। এছাড়াও যে কারণগুলো অনুমাণ করা যায়, তার মধ্যে একটি হচ্ছে, মেয়েদের বেশি বয়সে মা হওয়া। নগরায়নের কারণে পরিবেশগত সমস্যাকেও এ ক্ষেত্রে দায়ী করেন তিনি।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে যে গবেষণা পরিচালনা করে, সেখানে দেখা যায়, ঢাকায় শিশুদের অটিজমের হার ৩ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রামে এ হার মাত্র ০ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রথম সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে গর্ভপাত হওয়ার জন্যে আরো তিনটি বিষয়কে দায়ী করেন ডা. কাজল।
তিনি মায়ের বেশি বয়স ছাড়াও পরিবেশগত সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, আমাদের শহরের বাতাস, পানি এবং খাবারে বিষাক্ত উপাদান থাকে, সেগুলোও সন্তান গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। খাদ্যে ফরমালিন, মার্কারি, স্টেরয়েড, হরমোনের অতিরিক্ত ব্যবহার ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে মায়ের জন্যে।
আমাদের বাজারে এন্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতা যেমন, এন্টি ফাঞ্জেট, সিপ্রোফ্রেক্সিন এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক মেয়েদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে।
এছাড়াও প্রকৃতিগত কারণ রয়েছে। যেমন, জরায়ুর গঠনগত ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে অসুস্থতাও দায়ী।
মেয়েদের মা হওয়ার জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত বয়স হিসেবে ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সকে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, এই সময় মেয়েদের উর্বরতা ভালো থাকে। আমাদের সরকার থেকে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে এবং মা হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। কিন্তু একই সঙ্গে ২৫ বছরের আগে ‘মা’ হওয়া নিরাপদ- এ তথ্যটিও প্রচার করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশক ধরেই বাড়ছে সময়ের আগেই গর্ভপাত হওয়া এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি ৪টি গর্ভের মধ্যে একটি গর্ভপাত হচ্ছে। স্বাস্থ্য সর্ম্পকিত বৈশ্বিক পত্রিকা ল্যনসেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি বছর ৫ কোটি ৬০ লাখ গর্ভপাত হয়। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা ভয়াবহ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৬
এমএন/এএসআর