নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে ডায়রিয়া পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। টানা ২ সপ্তাহ ধরে শুধু সদর জেনারেল হাসপাতালেই নিয়মিত গড়ে দেড়শ রোগী চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন ও ভর্তি হচ্ছেন।
শুক্রবার (৮ এপ্রিল) ও বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) সদর জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে এবং জেলা সিভিল সার্জনের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানা যায়।
এর আগে গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নারায়ণগঞ্জে হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
সারাদিন রোজা রেখে ইফতারে দইয়ের শরবত পান করেছিলেন মোরশেদা আক্তার (৩০)। শরবত পান করার পর থেকেই শুরু হয় পাতলা পায়খানা ও বমি। দেওভোগ ভূঁইয়ারবাগ এলাকার বাসিন্দা মোরশেদার সাথে কথা হয় ডায়রিয়া ওয়ার্ডে। এলাকাটি ওয়াসার আওতায়। ওয়াসার পানি ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করে দই মিশিয়ে শরবত তৈরি করে পান করার পরই মোরশেদা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। তার অনুমান, পানিতেই সমস্যা আছে। ইদানিং এমনিতেই পানিতে একটু বেশি গন্ধ পাওয়া যেত।
ফতুল্লার সালেহা বেগম ইফতারে গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। খানপুরের বিল্লাল মুরগীর মাংস দিয়ে সাহরি খাওয়ার পর আর রোজা রাখতে পারেননি। তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। বিল্লালের যত সন্দেহ ওয়াসার পানির দিকে। পশ্চিম দেওভোগ মাদ্রাসা এলাকার আশা বুধবার ইফতার খাওয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। চরসৈয়দপুরের শাহনাজ বেগম সাহরির সময় মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ডায়রিয়ার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েও হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ চিকিৎসা নিয়েছে ৯৪ জন রোগী। কিছুক্ষণ পরপরই রোগী আসছে। ১৬টি বেডে অনেক সময় রোগী সংকুলান হয় না। ২ ঘণ্টা পর রি-হাইড্রেশন পূর্ণ হলে প্রেসক্রিপশন দিয়ে রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানালেন, ডায়রিয়া ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স বীনা রানী মন্ডল। একটি স্যালাইন দেওয়ার পর রোগী একবার প্রসাব করলে বা একবার খাবার খেতে পারলে ধরে নেওয়া হয় তিনি সুস্থ্ হওয়ার পথে। এরপরই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডের একজন ব্রাদার জানালেন, রমজানের শুরু থেকে মহিলা ও শিশু রোগী আসছে বেশি। মহিলাদের বেশিরভাগই খোলা ইফতার, শরবত ও ব্রয়লার মুরগী খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি অন্তত ১০ জন ডায়রিয়া রোগীর মধ্যে ৮ জন নারী খোলা ইফতার, শরবত ও মুরগির মাংস খাওয়ার পরই আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান।
১৪ মাসের শিশু রিয়ানকে মুখে সাদা ভাত দিয়েছিল মা-বাবা। রিয়ান সেই যে বমি শুরু করেছে। তার সঙ্গে চলছে পায়খানা। পশ্চিম মাসদাইর প্রাইমারি স্কুল এলাকার বাসিন্দা শাহিদা বেগম জানালেন, রিয়ান তার মেয়ের ঘরের নাতি। সাদা ভাত থেকেই রিয়ান বমি শুরু করে। কিন্তু তার মেয়ে বলছিলেন, হয়তো খাওয়ার পানি থেকেও সমস্যা হতে পারে।
ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ হলেও নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আসা রোগীরা কেউই পানির সমস্যার কথা বলছেন না। তাদের ধারনা সর্বশেষ খাওয়া খাবার থেকেই ডায়রিয়া আক্রমণ করছে। যেমন, খোলা ইফাতার, শরবত খাওয়ার পর নাকি তারা ডারিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালের নার্স ও চিকিৎসকরা জানান, আসলে মানুষতো সব খাবারের সঙ্গেই পানি পান করেন। তাই পানিকে তারা খাবারের উপাদান মনে করে না।
রোজার শুরু থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহর, বন্দর, শহরতলী ও আশপাশ এলাকা থেকে ডায়রিয়ার রোগী আসছে। দৈনিক অন্তত ১৫০ জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল। বিশেষ করে সিদ্ধিরগঞ্জের চৌধুরী বাড়ি ও বন্দরের মদনপুর, বক্তাবলী, সৈয়দপুর, হাজীগঞ্জ, কায়েমপুর, লামাপাড়া, ইসদাইর, তল্লা, সবুজবাগ, গোদনাইল, গাবতলী, পঞ্চবটি, কুতুবপুর, পাইকপাড়া, ফরাজীকান্দা আলসাবা আবাসিক এলাকা, কাশীপুরের ভোলাইল, মাসদাইর বারৈভোগ ও পশ্চিম দেওভোগ মাদ্রাসার শেষমাথা এলাকা থেকেও ডায়রিয়া রোগী আসছে।
রেজিয়া বেগম (৫০)। বন্দরের মদনগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। তিনি জানালেন, তিনি রোজা রেখেছিলেন। বুধবার ইফতার খাওয়ার পরই পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে। শুরু হয় বমি। এলাকার ফার্মেসি থেকে পাতলা পায়খানার ট্যাবলেট এনে খেয়েছিলেন। কাজ হয়নি। রাতটা কোনমতে পার করে বৃহস্পতিবার সকালে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেন। দুপুর ১টা নাগাদ তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বাড়ি ফেরার পথে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। রেজিয়া বেগম বলতে পারছিলেন না ঠিক কি কারণে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেন। তবে তার মেয়ের দাবি, ওয়াসার পানির কারণেই তার মা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখন থেকে তারা পানি ফুটিয়ে পান করবেন বলে জানালেন।
ফতুল্লার সালেহা বেগম জানালেন, তারা ডিপ টিউবয়েলের পানি পান করেন। সাহরির সময় মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন। এরপর থেকেই সমস্যা শুরু। তল্লা এলাকার সাইমেরী জানান, এমনিতেই তাদের এলাকায় পানি সংকট চলছে। সম্ভবত ওয়াসার পানি থেকেই ডায়রিয়া হয়েছে। এলাকার অনেকেই হাসপাতালে এসেছে। চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ চৌধুরী বাড়ি এলাকার আনাম জানান, প্রচণ্ড গরমে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এরমধ্যে পবিত্র রমজান মাসে সর্বত্র ভেজালের কারবার। খোলা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ইফতার। রান্নার সয়াবিন তেলেও ভেজাল হচ্ছে। সয়াবিনের দাম বেশি হওয়ায় অসাধু চক্র সয়াবিনের সঙ্গে নিম্নমানের পামঅয়েল মেশাচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষ নানাভাবে অসুখে ভুগছেন। হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগী বেশি আসছে।
রামারবাগ এলাকার বিউটি জানান, গরম ও পানির কারণেই ডায়রিয়া বেড়েছে। জেলা পরিষদ এলাকার মমিনুল বলেন, সাহরির সময় মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। সকালে হঠাৎ করেই শুরু হয় পাতলা পায়খানা। ভিক্টোরিয়ায় চিকিৎসা নিলাম। ভয় কাটছে। এখন বাসায় ফিরছি।
সৈয়দপুরের রাজিব, কাশীপুর ভোলাইলের সীমা, মদনগঞ্জের পারুল বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জের চৌধুরী বাড়ির শ্রীকৃষ্ণ ও বক্তাবলীর জাকিয়া ইফতার খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মশিউর রহমান জানান, আমাদের সদর জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন ইনডোর আউটডোর মিলিয়ে দেড়শ রোগী গড়ে চিকিৎসা সেবা নেন। এদের মধ্যে অনেকেই ভর্তি হন। একই অবস্থা জেলার অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও। আসলে এ সময়টাতে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে, এটি পানিবাহিত রোগ। আমরা সবাইকে সচেতন থেকে খাবার গ্রহণে আহবান জানাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২২
এমআরপি