তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ সংশোধনের জন্য যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনার জন্য হাজারের বেশি মতামত জমা পড়েছে। কেউ কেউ এই সংশোধনীকে স্বাগত জানিয়েছেন।
২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে (২০১৩ সালে সংশোধন) আরেকটি সংশোধনী আনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়। এ বছরের ১৪ জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়ে তাতে জনগণের মতামত চাওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, প্রস্তাবিত বিধানগুলোর পক্ষে এবং বিপক্ষে এক হাজারেরও বেশি মতামত জমা পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের যে প্রবণতা, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মাধ্যে তা ৪৪% থেকে ৩৪.৭% এ নেমে এসেছে।
ওয়েবসাইটে দেওয়া মতামতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি এই বিধান সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি এবং এই খাতের সঙ্গে যুক্ত ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার ওপর এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেহেতু এই খাতটি মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ১৩% অবদান রাখে, তাই প্রস্তাবিত বিধিনিষেধগুলো বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতায় সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহকে আরও কমিয়ে দেবে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি অ্যাসোসিয়েশন এবং ব্যবসায়িক চেম্বার প্রস্তাবিত সংশোধনীর বেশ কিছু ধারা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশ (নাসিব), বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি, এফবিসিসিআই, এমসিসিআই, ডিসিসিআই, ফরেইন ইনভেস্টরর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি, বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেন্ডসটা), বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি, এছাড়া আছেন আইনজীবী ও শিক্ষাবিদ। তারা আশংকা করছেন, নতুন এই সংশোধনী প্রণীত হলে এই খাতের সাথে সম্পৃক্ত প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের অবনতি ছাড়াও বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব কমবে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ বিষয়ে নাসিব সভাপতি সিআইপি মির্জা নুরুল গনি শোভন বলেন, “ভাসমান ফেরিওয়ালাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, বাধ্যতামূলক খুচরা লাইসেন্সসহ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রিতে প্রস্তাবিত অযৌক্তিক বিধিনিষেধ ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবিকাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। নতুন এই প্রস্তাবনায় লাইসেন্স না থাকা মানে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। অথচ এই ছোট ব্যবসা প্ৰতিষ্ঠান এবং প্রান্তিক খুচরা বিক্রেতারা প্রতিদিন ৫০০ টাকাও লাভ করেন না। ”
তিনি আরও বলেন, “আমরা তামাকের ব্যবহার কমানোর বিপক্ষে নই, তবে কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতির বাস্তবতায় আমাদের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রসার সম্পর্কেও ভাবতে হবে। আমরা যদি তাদের জন্য আয়ের বিকল্প উৎসের ব্যবস্থা না করি, তাহলে ছোট ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বেকারত্বের হার বাড়বে। ”
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন ধূমপানের নির্ধারিত স্থান সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা এবং একক-শলাকা বিক্রয় নিষিদ্ধের মতো বিধানগুলি ধূমপান হ্রাসকরণে এ অবধি যে অগ্রগতি হয়েছে, তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যদি ধূমপানের জন্য কোনো নির্দিষ্ট এলাকা না থাকে, তাহলে সাধারণ জনগণ যত্রতত্রভাবে নিজ সুবিধানুযায়ী ধূমপান করবে এবং পরোক্ষ ধূমপানের মাধ্যমে তা অন্যদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এমনকি কঠোর তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে এমন দেশগুলোতেও ধূমপানের নির্ধারিত স্থান রয়েছে। একইসাথে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ধূমপায়ীদের কাছে পুরো প্যাকেট থাকলে তারা অপেক্ষাকৃত বেশি ধূমপান করেন।
অধিকন্তু, যুক্তরাজ্য, নিউজিলান্ড, কানাডা ও অন্যান্য উন্নত দেশ যেখানে ধূমপান হ্রাসে ভ্যাপিং পণ্য, ই-সিগারেট, নিকোটিন পাউচ ইত্যাদি ব্যবহারে উৎসাহী করছে, সেখানে বাংলাদেশে ধূমপানের বিকল্প এসব পণ্যে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে।
বেন্ডসটা- এর সভাপতি মাসুদ উজ জামানের মতে, ইউকে হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি (পূর্বে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড নামে পরিচিত) এর গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানের চেয়ে ভ্যাপিং ৯৫% কম ক্ষতিকারক।
তিনি বলেন, “নীতিনির্ধারকরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারেন না। আমরা বিশ্বাস করি যে ভ্যাপিং বাংলাদেশে ধূমপান কমাতে সাহায্য করবে এবং এটিকে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অধীনে নিয়ন্ত্রণ করা হলে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘তামাকমুক্ত’ করার যে লক্ষ্য, তা বাস্তবায়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ”
তিনি আরও বলেন, “বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ইউকে অ্যাকশন অন স্মোকিং অ্যান্ড হেলথের তথ্য থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে ভেপারের সংখ্যা ২০১২-২০১৯ এই বছরগুলোতে ৭ লাখ থেকে ৩৬ লাখে উন্নীত হয়েছে এবং ৫৪% সফলভাবে ধূমপান ত্যাগ করেছে। ই-সিগারেট ব্যবহারকারীগণ গতানুগতিক ধোঁয়ার পরিবর্তে বাষ্পে নিকোটিন গ্রহণ করছে যা এটিকে আরও নিরাপদ করে তোলে। ”
বেন্ডসটা ছাড়াও ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থলোস ফাউন্ডেশন এবং ইউরোপের ১৭ জন সুপরিচিত আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি দল ধূমপানের উপরোক্ত নিরাপদ বিকল্পগুলো নিষিদ্ধ করার বিধানের বিরুদ্ধে তাদের মতামত জমা দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের অর্থনীতির একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ খাতকে বিপন্ন করতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অবশ্যই বর্তমান সামষ্টিক-অর্থনৈতিক সমস্যা এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে।