ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ভারত

কলকাতা বইমেলায় ফিরল রাজশাহীর কালি ‘সুলেখা’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩
কলকাতা বইমেলায় ফিরল রাজশাহীর কালি ‘সুলেখা’

কলকাতা: অবিভক্ত ভারত, তখনও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি ভারত। বিদেশি বর্জন আর স্বদেশি জিনিসের ব্যবহারে জোর দিয়ে আন্দোলন তখন জোরকদমে চলছে।

সে সময় পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর স্বাধীনতা সংগ্রামী ননীগোপাল মৈত্র ও তার ভাই শঙ্করাচার্য মৈত্র স্বদেশি কালি তৈরির উদ্যোগ নেন। দুই ভাইয়ের উদ্যোগে রাজশাহীতে তৈরি হয় স্বদেশি কালি। বাংলা তো বটেই, একটা সময় ভারতজুড়ে কালির চাহিদা শুরু তৈরি হয়। চাহিদা এতটাই বাড়ে যে রীতিমত ব্যবসায়িক উৎপাদন শুরু হয়। এ কালি দিয়ে সুন্দর লেখা যায়। তাই এর নাম দেওয়া হয় ‘সু লেখা’। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন, ‘কলঙ্কের চেয়েও কালো’। ফলে এ কালি বাঙালিকে চেনাতে হয় না। বাঙালির চেতনার অপর নাম সুলেখা। যুগযুগ ধরে ঝর্ণা কলমের সমার্থক সুলেখা।

কিন্তু বলপেনের দাপটে অর্ধশতাব্দীর মধ্যে পাততাড়ি গুটোতে হয়েছিল বাঙালির এই নস্টালজিয়াকে। একটা সময় সুলেখা বলতে কলকাতার প্রজন্মরা চিনত যাদবপুর ইউনিভার্সিটির পরের বাস স্টপেজ ‘সুলেখার মোড়’। কিন্তু এই নামকরণের সাথে বাঙালির কত ইতিহাস, কাগজে-কলমে কত সৃষ্টি ছড়িয়ে আছে, সেই স্মৃতি প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছিল। নস্টালজিক সেই ইতিহাস পাতা ছেড়ে সুলেখা ফিরেছে ৪৬তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়। মেলা প্রাঙ্গনে প্রথম দিন থেকে তারা স্বমহিমায়। ৬ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে সোজা এগোলেই বাঁ দিকে ২৫৩ নম্বর স্টল। তাদের ইউএসপি- স্বাধীনতা, বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলন।

 

স্টলের বাইরে থরে থরে সাজিয়ে রাখা কালির বাক্স। কোনওটির গায়ে ভারতের জাতীয় পতাকা, কোনওটিতে শহিদ ক্ষুদিরাম বসু, কবি সুকান্ত, কোনোটির গায়ে একুশের ভাষা আন্দোলন আবার কোনোটিতে বাংলাদেশের গর্বের ৫০ বছর। কালির বাক্সের প্রচ্ছদে ভারতের জাতীয় পতাকার রং থাকা কালির নাম ‘স্বরাজ’। ক্ষুদিরামের ছবি ছাপা বাক্সটির পরিচয় ‘স্বাধীন’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে ‘গর্বের ৫০’ অপর কালির নাম ‘সমর্পণ’। ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘সেলাম’, সে বাক্সের পেছনে লেখা ‘আমি কি ভুলিতে পারি। ’ সাথে মাতৃভাষার মর্যাদা রাখতে গিয়ে রক্ত দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, শফিউর, জব্বারের নাম।

এছাড়া রয়েছে ফিরিঙ্গি কালি। শিশুদের জন্য ‘হাতেখড়ি’ সিরিজের ঝর্ণা কলমের চাহিদাও কম নেই। সুলেখার মার্কেটিং বিভাগের দায়িত্বে থাকা সুগম রায় জানালেন, এবারের মূল আকর্ষণ সংস্থার পুরনো আমলের কিছু ফাউন্টেন পেন। সেই কলম অবশ্য কেমন দেখতে, তা অবশ্য জানা গেল না। আপাদমস্তক সাদা ফোমে জড়ানো। দাম আড়াই হাজার রুপি। এছাড়া অতীতে যেমন কালি ভারে ঝর্ণা কলম ব্যবহার হত তার দাম শুরু ৩০০ রুপি থেকে।

 

ডিজিটাল যুগে কলমের ব্যবহার মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছেন, সেখানে সুলেখা কালির আগমন। এ বিষয়ে সুগম রায় জানান, সর্বত্রই দেখবেন পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। পুরনো ফ্যাশন এবং পুরনো ট্রেডিশন মানুষ বেশি পছন্দ করেছেন। আমরা আশা যা করেছিলাম তার থেকে বিক্রি বেশি। বইমেলায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা এতটা পাব কল্পনা করিনি। আমাদের কাউন্টার থেকে যখন পুশ সেল করতে হয়, বইমেলায় সেটা করতে হচ্ছে না। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কালি কিনছেন। অনেকেই বলছেন, তাদের বাড়িতে কলম রয়ে গেছে, কালি ছিল না। অনেকে আবার নস্টালজিক হয়ে কিনছেন। এছাড়া সময়োপযোগী কিছু কলম তৈরি হয়েছে, আগে যেমন কলমে কালি ঢালতে গিয়ে শিশুরা হাতে-পায়ে মাখতো সেই সমস্যাটা নেই। তবে সব থেকে বেশি প্রবীনদের উৎসাহটা বেশি। আমরাও চাই আগে প্রবীণরা উৎসাহ বোধ করুক, পরে প্রজন্মরা।

 

তিনি বলেন, দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর কারখানা বন্ধ থাকার পর আবার আমরা মানুষের সামনে এসেছি এবং বইমেলার প্রথম। বিদেশি জিনিস বর্জন এবং মহাত্মা গান্ধী যখন জেলে ছিলেন তখন আমাদের কর্ণধার ননীগোপাল মৈত্র ও তার ভাই শঙ্করাচার্য মৈত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে নাম লেখান। পরে তাঁদের চিন্তায় আসে বিদেশি কালির পরিবর্তে ব্যবহার হোক স্বদেশি কালি। সেই চিন্তাভাবনা থেকে অবিভক্ত বাংলার রাজশাহীর নিজেদের বাড়ি থেকে প্রথম সুলেখা কালি তৈরি করেন তাঁরা। পরবর্তীতে, সুলেখার চাহিদায় ১৯৩৪ সালে কলকাতার যাদবপুরে কারখানা তৈরি হয়। ১৯৮৬ সাল অবদি চলেছিল। মাঝে ২২ বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৬ সালে চালু করা হয়। এরপর মাঝে দু বছর লকডাউনে বন্ধ হয়। চাহিদার কারণে ফের ফিরে এলাম আমরা।

৪৫ ঊর্ধ্ব কলকাতাবাসী সুকন্যা জানালেন, বইমেলায় এসে হাতের কাছে এমনটা পাব, স্বপ্নেও ভাবিনি। ছেলের জন্য একটি পেন দর করছিলেন। কিন্তু ঢাকনা খুলে অবাক। কোনও নিব তো নাই! হাসতে হাসতে সুগম রায় দেখিয়ে দিলেন, ‘একে বলে ভ্যানিশিং নিব। এইখানটা একটু ঘোরান... আর এই দেখুন। ’ ভিতর থেকে নিব বেরিয়ে আসা দেখে শিশুর মতো হেসে ফেললেন সুকন্যা। জানতে চাইলেন দাম। মাত্র ৩৫০ রুপি। ছোটবেলায় সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তাই ছেলের জন্য কিনে ফেললাম। সাথে কিনলেন এক বাক্স ‘সেলাম’। তার মত, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এটাই বেছে নিলাম।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩
ভিএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।