কলকাতা: কলকাতায় মাটির ভাড়ে চা পান আজ শুধু অভ্যাসের জেরে ব্যবহার নয়, এটাক এক ঐতিহ্য। যেমন কলকাতার আদমরিকশা, ট্রাম বা হলুদ ট্যাক্সি।
পশ্চিমবঙ্গবাসীর সঙ্গে কলকাতায় মাটির ভাড়ে চা-পান বাংলাদেশিরাও পছন্দ করেন। চিকিৎসা, ভ্রমণ বা ব্যবসা -যে কারণে বাংলাদেশিরা শহর কলকাতায় পা রাখেন, একবার হলেও মাটির ভাড়ে চায়ের স্বাদ নেবেনই। আর অতি সত্য, সেই মুহূর্তটায় মাটির ঘ্রাণে চায়ের চুমুক যেনো আলাদা তৃপ্তি এনে দেয়। যা গোটা ভারতের আর কোথাও দেখা যায় না।
যদিও একটা সময় বিহার, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশে মাটির ভাড়ে চায়ের দেখা মিলত। এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বলতে গেলে, ট্রাম, ট্যাক্সি, রিক্সার মত মাটির ভাড় টিকে আছে কলকাতায়। তবে এই ঐতিহ্যও বিলুপ্তির পথে।
কারণ সেই মাটির ভাড়ে ভাগ বসিয়েছে যন্ত্র দিয়ে তৈরি প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম কাপ। ইচ্ছে না থাকলেও তাতেই অভ্যস্ত হতে হচ্ছে শহরবাসীকে। তবে কিছু শ্রমিকের শ্রমে শহরে আজও টিকে আছে মাটির ভাড়। তাদের মধ্যে একজন সজীব পাল।
কলকাতার কালীঘাটের বাসিন্দা মৃৎশিল্পী সজীব পাল। সজীবের ছোট্ট একটা কারখানা। আছে একজন শ্রমিক। চার দশকে মৃৎশিল্পী তিনি। শহরজুড়ে যখন প্লাস্টিকের রমরমা বাজার তখন সজীবের কারখানার ব্যস্ততা জানান দিচ্ছে, চা বিক্রেতারা যতই সস্তা দামের প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক মিশ্রিত কাগজের কাপ ব্যবহার করুক না কেনো, চা প্রেমীদের কাছে মাটির ভাড়ের কদর এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
মূলত, প্লাস্টিকের যুগে শহরের বহু মৃৎশিল্পীর কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
শহরের অনেক নাগরিক পেটের দায়ে শ্রমের পরিবর্তন এনেছেন। তখন প্রদীপের শেষ হয়ে যাওয়া সলতের মতো জেগে আছে কলকাতার সজীব পালেরা।
প্লাস্টিকের ব্যবহারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের বিধি আরোপ করেছে। তা মানছে কই? তবে তাতেই সজীবের ব্যবসায় সুদিন যেন শুরু হয়েছে। সজীব জানান, সেই সুদিনকে আরও সুবিধা করে দিয়েছে চিকিৎসকদের সাম্প্রতিক এক নির্দেশিকা।
সম্প্রতি চিকিৎসকদের এক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, প্লাস্টিক কাপে গরম চা-পান করলে শরীরে কতটা ক্ষতি করতে পারে। পথে চা পানের জন্য মাটির ভাড়ের ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ঢিল ছোড়া দূরত্বে মৃতপ্রায় গঙ্গা নদী। যাকে শহরবাসী কালীঘাট গঙ্গা নামে চেনেন। সেই কালীঘাট গঙ্গার ব্রিজের নিচে সজীবের কারখানা। ঘুরন্ত চাকা আরেকটু সচল করে শৈল্পিক হাত রাখলেন একদলা মসৃণ কাদার উপর। চাকা থেকে চোখ না সরিয়ে, নতুন কাঁচা ভার একটা একটা করে সাজাতে সাজাতে কথা বলতে লাগলেন তিনি। বয়সের কারণে সহযোগিতার জন্য আছে এক বিহারী শ্রমিক। নাম তার অরুন ঠাকুর।
সজীব বলেন, আগে তো লাঠির সাহায্যে এই চাকা ঘুরাতে হত। এখন বিদ্যুতের কারণে মোটরের মাধ্যমে এ চাকা ঘোরে। একসময় প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম কাপের রমরমা বাজারে কারণে ভাড়ের দাম কমে হয়েছিল ৩০- ৪০ রুপি, শতক। এখন একশো ভাড় বিক্রি হয় ৭০ রুপিতে। তবে চাহিদা অনুযায়ী, বাড়তি অর্ডার মেলায় শত ভাড় আসি রুপি নিচ্ছেন সজীব।
তিনি জানান, এরকম চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি একশো রুপি ছুয়ে যাবে। তখন সজীবের ঠোঁটের কোণে খুশির হাসি দেখা গেল। তার মতে, সারাদিনের শ্রম দিলে একা ৫০০ চায়ের ভাড় তৈরি করতে পারি। তাতেই চলে যায়। তার অভিমত, নিয়মিত আসা অর্ডার থেকে আমরা বুঝতে পারছি ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের কাপের দিন শেষ হয়ে আসছে। মুখ্যমন্ত্রী যদি মৃৎশিল্পের দিকে নজর দিত অর্থাৎ সরকারের আর্থিক সহায়তা পেলে যেসব মৃৎশিল্পীরা নিজেদেরকে এই পেশা থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তারা আবার ফিরে আসবে। বাংলায় ঘুরে দাঁড়াবে মাটির পাত্রের ব্যবহার।
চায়ের দোকান গুলোর পাশাপাশি একসময় শহরের অনুষ্ঠান বাড়িগুলোতেও দেখা যেত মাটির থালা বাটির ব্যবহার। এখন চিনেমাটির যুগে বোন চায়না প্লেটের কদর বেশি। কোথাও আবার মেলামাইন। তবে অনেকে অনুষ্ঠান বাড়ি পুরনো কায়দায় মাটির থালা, বাটির, গ্লাসের মধ্য দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন সারছেন। আর এসবের ব্যবহার যত বাড়বে সজীবদের সঙ্গে বাঁচবে পরিবেশ। এমনটাই মত চিকিৎসক থেকে পরিবেশবিদদের।
কারণ, এগুলো একবারই ব্যবহার করা হয়। ফেলে দিলে, ক্ষতি না করে সহজে মিশে যায় পরিবেশের সাথে। আর সে কারণে সজীবের মত কিছু মানুষের শ্রমে এখনও কলকাতায় হারিয়ে যায়নি মাটির পাত্রের ব্যবহার। টিকে আছে পরিবেশ।
কিন্তু, সরকারের সহযোগিতা না পেলে আর কতদিন তারা এ পেশায় টিকে থাকবেন। হয় বন্ধ হোক প্লাস্টিকের ব্যবহার নয় তো, আর্থিক সহযোগিতায় টিকিয়ে রাখা হোক সজীবদের। এমনটাই মত শহরবাসীর। ঘূর্ণায়মান চাকায় কুমোরের শৈল্পিক হাতের স্পর্শে কাদামাটি আরও বেশি করে রূপ পাক মাটির পাত্রে। বেঁচে থাকুক হারিয়ে যাওয়া বাংলার কুটিরশিল্প। আবারও জোরে ঘুরতে শুরু করুক কুমোরের চাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০২৩
ভিএস/এসএএইচ