ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

ব্রিটিশ আমলের নিয়ম বাতিল

ভারতে কার্যকর নতুন আইন, গণপিটুনির শাস্তিও হতে পারে মৃত্যুদণ্ড

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৮ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০২৪
ভারতে কার্যকর নতুন আইন, গণপিটুনির শাস্তিও হতে পারে মৃত্যুদণ্ড

কলকাতা: বিরোধীদের আপত্তি উপেক্ষা করে ভারতে কার্যকর হলো তিনটি নতুন ফৌজদারি আইন—‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’, ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ এবং ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’।

সোমবার (১ জুলাই) আইন তিনটি কার্যকর হওয়ার ফলে ভারতীয় আইন ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি মুছে গেল ব্রিটিশ আমলের নিয়মগুলো।

এর বদলে জায়গা করে নিল ভারতের নতুন আইন। কেন্দ্র সরকারের দাবি, এতদিন আইনে সাজার যে কথা বলা ছিল, এবার নতুন আইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পান, সেই ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে।

১৮৬০ সালে তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’, বাংলায় যার অর্থ ‘ভারতীয় দণ্ডবিধি’। তার পরিবর্তে আনা হলো ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’। ১৮৯৮ সালের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ বা ‘ফৌজদারি দণ্ডবিধি’র নতুন রূপ ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ এবং ১৮৭২ সালের ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ বা ‘ভারতীয় সাক্ষ্য আইন’-এর বদলে কার্যকর হলো ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’।

অর্থাৎ ‘ভারতীয় দণ্ডবিধি’র বদলে ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’, ‘ফৌজদারি দণ্ডবিধি’র বদলে ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ এবং ‘ভারতীয় সাক্ষ্য আইন’-এর জায়গায় এলো ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’। বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে সময়মতো বিচারপ্রাপ্তি, নারী ও শিশু সুরক্ষা এবং অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষায়। বদল হয়েছে দেশদ্রোহিতার সংজ্ঞা এবং আলাদা ধারা আনা হয়েছে গণপিটুনির ক্ষেত্রে।

এর ফলে ১ জুলাই থেকে ফৌজদারি মামলাগুলির ক্ষেত্রে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে দেশটির পুলিশ-প্রশাসন, আইনজীবী, এমনকি বিচারক বিচারপতিদেরও। নতুন আইনে কী কী অপরাধ এবং তার শাস্তি হিসেবে কী বলা হয়েছে, তা নিয়ে ধন্দে আছেন অনেকেই।

ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় নতুন ২০টি অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে। বাদ পড়েছে ১৯টি নিয়ম। একই সঙ্গে ৩৩টি অপরাধের জন্য কারাদণ্ডের সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৮৩টি অপরাধের জন্য জরিমানার পরিমাণও আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার ২৩টি এমন অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে একটি বাধ্যতামূলক সর্বনিম্ন শাস্তির কথা বলা রয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়।

হত্যা ও আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া, আক্রমণ, গুরুতর আঘাতের মতো অপরাধগুলির জন্য এতদিন ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ (ভারতীয় দণ্ডবিধি)-তে যে নিয়মগুলি ছিল, সেগুলি বজায় থাকছে নতুন আইনেও। পাশপাশি এতে যুক্ত হয়েছে সংগঠিত অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, গণহত্যার মতো অপরাধ।

নতুন আইনে নারী সুরক্ষা এবং নারীদের সঙ্গে বিভিন্ন ঘটে যাওয়া অপরাধের ক্ষেত্রে নিয়ম আরও কঠোর করা হয়েছে। নতুন আইনে ১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ নাবালিকা ধর্ষণে সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ বছর থেকে আজীবন কারাবাসের সাজার কথা বলা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের মামলার ক্ষেত্রে নির্যাতিতার বয়ান নেওয়া হবে সংশ্লিষ্টের বাসভবনেই। সেখানে একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সেই বয়ান নথিবদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়। বিয়ে বা অন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অপরাধের জন্য ১০ বছরের সাজার কথা বলা হয়েছে।

চুরি, ডাকাতি, প্রতারণার মতো অপরাধের জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধিতে যে নিয়মগুলি ছিল সেগুলি নতুন আইনেও থাকছে। এছাড়াও যুক্ত হয়েছে সাইবার অপরাধ এবং আর্থিক প্রতারণার মতো অপরাধ।

এতদিন গণপিটুনির ক্ষেত্রে ভারতে কোনো আলাদা আইন ছিল না। এবার এই অপরাধে কারো মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজার কথা বলা রয়েছে। পাশাপাশি, পরিবেশ দূষণ এবং মানব পাচারের মতো অপরাধকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় সাজার আওতায় আনা হয়েছে। এজন্য আলাদা আলাদা নিয়মের কথাও রয়েছে এই আইনে। এমনকি, নারীদের গহনা বা মোবাইল ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার বিচারের জন্যও রয়েছে আলাদা আইন।

ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় দেশদ্রোহের মতো অপরাধকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তবে তার পরিবর্তে ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতাকে বিপন্ন করাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। নতুন আইনে সেই অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট সাজার কথাও বলা রয়েছে।

শুধু ভারতীয় ন্যায় সংহিতা নয়, ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ বা ‘ফৌজদারি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিছু ধারা বাতিল করা হয়েছে, কিছু সংশোধনও হয়েছে। নতুন আইনে অভিযুক্তের অধিকারকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলা রয়েছে। অভিযুক্তের এমন অধিকার থাকবে, যাতে তিনি নিজের পছন্দের আইনজীবী বেছে নিতে পারেন।

পুলিশ যদি কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করে তবে তার সংশ্লিষ্টকে অবশ্যই জানাতে হবে কোন অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার ব্যক্তির শারীরিক পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারকে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দক্ষতার উন্নতির কথাও নতুন আইনে বলা হয়েছে।

তবে বৃহত্তর স্বার্থে কোনো ব্যক্তিকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যাবে। পুলিশকে অপরাধের তদন্তের স্বার্থে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়ার কথাও রয়েছে নতুন আইনে। বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে মামলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিষয়ও উল্লেখ রয়েছে।

একই রকমভাবে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’ কার্যকর হয়েছে অনেক নতুন নিয়ম নিয়ে। অপরাধের প্রমাণ জোগাড়ে ভিডিও রেকর্ডিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেই ভিডিও প্রমাণ বাজেয়াপ্ত করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিম্ন আদালতে জমাও দিতে বলা হয়েছে। নতুন আইনে এও বলা হয়েছে যে, কেউ অনলাইনে অভিযোগ করলে তিনদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে এফআইআরে সই না করলে সেটি গ্রাহ্য করা হবে না।

বিরোধীদের সব বিতর্ককে সরিয়ে রেখে সোমবার থেকেই ভারতে কার্যকর হয়ে গেল নতুন এই তিন আইন। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ, জেল, ফরেন্সিক বিভাগ এবং বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৭৪ জনকে নতুন আইনের ব্যাপারে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। চালু হয়েছে অ্যাপও। তারপরও চুরি-ডাকাতির মতো সাধারণ অপরাধের নতুন ধারা মুখস্থ করতে ঘাম ছুটছে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাদের। অনলাইনে অভিযোগ দায়ের, এসএমএস-এ সমন কিংবা যেকোনও থানায় ‘জিরো এফআইআর’ করার মতো নিয়ম চালু হচ্ছে।

তবে আইনজীবীদের একাংশেরও দাবি, এই তিন আইনে পুলিশের হাতে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা অতীতে ছিল না। তার উপরে তিন আইন চালুর ফলে গোটা দেশে আইনি জটিলতা বেড়ে গেল। ইতোমধ্যেই তিন আইনের বিরোধিতায় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘনিষ্ঠ মহলে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এটা নরেন্দ্র মোদীর আরও এক স্বৈরাচারী পদক্ষেপ। পুলিশি রাষ্ট্র তৈরির দিকে এগচ্ছে ওরা। নতুন ফৌজদারি আইনকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে দাবি করেছেন মমতা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৬ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০২৪
ভিএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।