বাংলাদেশের সঙ্গে ভাষা-সংস্কৃতির মিল থাকা এই শহরকে বরাবর কেন জানি আপন মনে হয়। আর এজন্য সিনেমা ও বইয়ের পাতায় দেখা কলকাতাকে স্বচক্ষে দেখার অদম্য ইচ্ছা বেশ পুরনো।
সাহিত্য বোঝার ক্ষমতা অতোটা না থাকলেও সাহিত্যের শাখা-প্রশাখা, উপন্যাস, গল্পের প্রতি টান ছিলো বরাবর। বাংলাদেশি লেখকের পাশাপাশি প্রিয় লেখকের তালিকায় রয়েছে কলকাতার লেখকরাও। যাদের লেখার অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে কলেজ স্ট্রিট।
কলেজ স্ট্রিটের ধারেই প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা মেডিকেল কলেজ। নারী জাগরণের অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেথুন কলেজসহ কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত অনেক বিদ্যাপীঠ রয়েছে সেখানে।
দিনভর কলকাতার নিউমার্কেটে শপিং শেষে সন্ধ্যায় হঠাৎ সিদ্ধান্তে ট্যাক্সি চেপে সোজা কলেজ স্ট্রিট। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শুনে ট্যাক্সি ভাড়া করা হলো। যদিও তারা বাসে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন। এরপরও ট্যাক্সিকে বেছে নেওয়া।
ট্যাক্সি থামলো প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে। আশপাশে তাকাতে চোখে পড়লো রাস্তার ধারে সারি সারি বইয়ের দোকান। পরিধি দেখে মনে হলো, আমাদের দেশের বাংলাবাজার আর নীলক্ষেত মিলে কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের মার্কেটের সমান হবে না। কলেজ স্ট্রিট বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও বিক্রয় কেন্দ্রের জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মূল্যবান নতুন-পুরনো সব ধরনের বই সংগ্রহ করতে চাইলে অনায়াসে পাওয়া যাবে এখানে।
রাস্তার সোডিয়াম বাতির আলো-আঁধারে কলেজ স্ট্রিটে হাঁটার সময় উপন্যাসের চরিত্রগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, শিল্পী ও নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে এই স্থানটি ছিলো আড্ডার মূল জায়গা। ইতিহাসের মহানায়কদের পদচারণায় এক সময় কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়া ও খাবারের দোকানগুলো ছিলো জমজমাট।
প্রায় দেড় কিলোমিটারজুড়ে কলেজ স্ট্রিট সড়ক। যার পরতে পরতে গাঁথা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস ও রাজনীতির উত্থান-পতনের কাহিনী। বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকদের হাতে সৃষ্টি শত শত উপন্যাস-গল্প-কবিতা।
প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটের উল্টো দিকে বিদ্যাসাগর উদ্যানের গেট। প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি। উদ্যানের ভেতরে রেলিং দিয়ে ঘেরা সুইমিং পুল। রয়েছে ছোট ছোট সুসজ্জিত বেঞ্চ। সেখানে বসে আড্ডায় মেতে রয়েছে তরুণ-তরুণীসহ নানা শ্রেণির মানুষ। পুরো উদ্যানজুড়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতায় অবদান রাখা মহানায়কদের ভাস্কর্য।
বিদ্যাসাগর উদ্যান থেকে বের হয়ে একটু এগোলেই বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মুখে বহুল প্রত্যাশিত ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউজ’। কলকাতার প্রখ্যাত সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ-পরিচালকরা আড্ডায় বুঁদ হতেন এই কফি হাউজে। একসময় সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো এই জায়গাটি। তবে কফি হাউজ আমার মতো অনেকের কাছে বেশি পরিচিত শিল্পী মান্না দে’র গলায় সৃষ্টি কালজয়ী সেই গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ নেই...’ এর জন্য। ভেতরে প্রবেশ করে কানে আসে রবীন্দ্র সংগীত। টেবিলভর্তি মানুষের গমগম আওয়াজ। আধুনিক ও চাকচিক্যময় রেস্তোরাঁয় কলকাতা শহর ছেয়ে গেলেও ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কফি হাউজের আর্কষণ এখনও কমেনি।
কলেজ স্ট্রিট থেকে ‘মা স্বরসতী আর্শীবাদ বই বিতান’ থেকে পুরনো কয়েকটি বই নিয়ে ফেরার পথে ১৫ টাকায় কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বাহন ট্রামে করে নিউমার্কেট। ধীরগতির হলেও ট্রাম মারকুইস স্ট্রিটের কলকাতা পৌরসভার সামনে নামিয়ে দেয় ১০ মিনিটে। যেখান থেকে নিউমার্কেটের দূরত্ব মাত্র তিন-চার মিনিটের।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৭
এমসি/আরআর/এসএনএস