ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

জানেন কি কলকাতার এ রাস্তাটার নাম কেন পার্কস্ট্রিট (ভিডিও)

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২১
জানেন কি কলকাতার এ রাস্তাটার নাম কেন পার্কস্ট্রিট (ভিডিও)

কলকাতা: ২০০৪ সাল থেকে কলকাতায় রাস্তাঘাটের নাম বদলানোর একটা হিড়িক পড়েছিল। তৎকালীন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেন ব্রিটিশ আমলের নাম পাল্টে বরেণ্য ব্যক্তিদের নামে নামকরণ করা হবে বহু রাস্তার।

নাম বদলের এ প্রথা চলেছিল আগামী একদশক ধরে। কিছু চলছে এখনও। কিন্তু তাতে কি আর ইতিহাস মুছে ফেলা যায়? নতুন নাম যাই হোক এখনও পুরোনো নামেই পরিচিত কলকাতার অধিকাংশ রাস্তা।

যেমন মধ্য কলকাতার অতিপরিচিত পার্কস্ট্রিট। তবে বর্তমানে নাম বদলে হয়েছে মাদার তেরেসা সরণি। তবুও শহরের অত্যন্ত এ গুরুত্বপূর্ণ রাজপথটির নাম লোকমুখে সেই পার্কস্ট্রিটই রয়ে গেছে। তা হবে নাই বা কেনো। পার্কস্ট্রিটের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে কলকাতার ৩০০ বছরের ইতিহাস।

জোব চার্নক নদীপথ ধরে পা রাখলেন কলকাতায়। তখন হুগলি নদীর তীর ছিল গ্রাম আর জলা-জঙ্গলে ভরা বিস্তৃত ফাঁকা জমি। সুতানটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা এ তিন অঞ্চলের সমন্বয়ে আজকের কলকাতা।

আজ যে অঞ্চলটা মধ্য কলকাতা। সেটার একসময় পরিচয় ছিল গোবিন্দপুর নামে। শহরে এক প্রবাদবাক্য ‘ধবধবে গোবিন্দপুর’অর্থাৎ সুবিশাল ফাঁকা অঞ্চল। এককালে কয়েকটা গ্রাম ছাড়া গোটা অঞ্চল ছিল জলে-জঙ্গলে পরিপূর্ণ।

পলাশির যুদ্ধের পরে ইংরেজরা নিজেদের বসতের জন্য গোবিন্দপুর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ফলে গ্রামের বাসিন্দাদের গ্রাম সেখান থেকে সরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পুনর্বাসন দিতে শুরু করেন তারা। সেই সময়ে এখনকার পার্কস্ট্রিট অঞ্চলে কিছু গ্রামবাসীকে পুনর্বাসন দেওয়ার কাজ শুরু হয়। ওই অঞ্চলের নাম তখন ছিল ‘বাদামতলা’। কিছু সময় পর ওই এলাকাও সাহেবদের দখলে চলে যায়। বাদামতলা লোকমুখে পরিচিতি পায় ‘সাহেব পাড়া’ নামে।

কলকাতা করপোরেশনের নথি বলছে, সরকারিভাবে রেকর্ডবুকে এ রাস্তার প্রথম নাম ওঠে ১৭৬০ সালে। নথি দেখলে বোঝা যায়, আজকের মাদার তেরেজা সরণি তথা অধুনা পার্কস্ট্রিট রাস্তাটির ক্ষেত্রে নাম বদল কোনও নতুন ঘটনা নয়। কলকাতা যত আকারে আয়তনে বেড়েছে, ততই বিবর্তন ঘটেছে পার্কস্ট্রিটের।

বিশাল ফাঁকা এলাকা। তাই সাহেবরা ঠিক করলেন সব কবর একটা নির্দিষ্ট এলাকায় থাক। ফলে এক সময়ের সাহেব পাড়া ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকে ইংরেজদের গোরস্থান হিসেবে। গড়ে ওঠে একাধিক কবরস্থান। সরকারিভাবে প্রথম রাস্তা পরিচিত পায় সমাধিস্থল অর্থাৎ ‘বুরিয়াল গ্রাউন্ড রোড’ নামে। অপরদিকে সাহেব পাড়া দেশীয়দের মুখে মুখে পরিচিতি পায় ‘গোরস্থান কা রাস্তা’ নামে।

ওই রাস্তা ধরে হাঁটলে পড়ে লোয়ার সার্কুলার রোড। সেই রোডের উত্তরদিকে একসময় ছিল সাহেবদের কবরস্থান ‘নর্থ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি’। পরে তা বন্ধ হয়ে সেখানে গড়ে ওঠে অ্যাসেম্বলি অব গড চার্চ স্কুল, বাজার, ব্যাঙ্ক, অফিস ইত্যাদি। তবে তার ঠিক বিপরীতে রয়েছে ‘সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি’। সেখানে রয়েছে হেনরি লুই ভিভিয়ান, ডি’রোজিও-র কবর।

আবার পার্কস্ট্রিটের পূর্বদিক বরাবার এগোলে লোয়ার সার্কুলার রোডের উপরে রয়েছে আরও একটি গোরস্থান। সেখানে রয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন প্রমুখের কবর। পার্ক স্ট্রিটের পার্শ্ববর্তী কড়েয়া রোডেও আছে আরও একটি স্কটিশ কবরখানা।

১৭৬০ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর হিসেবে হেনরি ভ্যান্সিটার্টকে নিযুক্ত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গভর্নর হেনরি ঔপনিবেশিক ধাঁচে যেই বাড়িতে থাকতেন, পরবর্তীকালে সেই বাড়িটিই হয় লরেটো হাউস স্কুল। ৫ নম্বর মিডলটন রো’য়ে আজও সেটি স্কুলেরই অংশ।

ঔপনিবেশিক ধাঁচের সেই বাড়ির লাগোয়া ছিল বিশাল বাগান। বাগানের মালিক ছিলেন উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড নামে এক সাহেব। তবে এ বাড়ির বিলাসিতা মাত্র চার বছর ভাগ করতে পেরেছিলেন গভর্নর হেনরি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন তখন পরিবার ফেলেই স্যার হেনরি ভ্যানসিটার্ট বাড়ির জানালা পথে নৌকা করে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন।

পরে বিভিন্ন সময়ে ওই বাড়িতে থেকেছেন তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পেসহ প্রমুখেরা। বিচারপতি ইম্পে ওই বাগানে হরিণ পুষতেন। তাই লোকমুখে জায়গাটির নাম হয় ‘ডিয়ার পার্ক’। পাশাপাশি ‘পার্কস্ট্রিট’ নামেও পরিচিতি পেতে থাকে। কারণ বাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল যে বিরাট বাগান, সেই বাগান অর্থাৎ পার্ক থেকেই পার্কস্ট্রিটের নামকরণ বলে মনে করেন দক্ষিণ ভারতীয় ঐতিহাসিক পি থাঙ্কপ্পন নায়ার। অনেক পরে সরকারি সিলমোহর পড়ে পার্কস্ট্রিট নামে।

একসময় এ পার্কস্ট্রিটের উপরেই ছিল বিখ্যাত সাহেবি নাট্যশালা সাঁসুচি থিয়েটার। পরে যেখানে হয়েছে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। আর আছে এশিয়াটিক সোসাইটি। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সূচনা হয়েছিল।

এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়িতেই। আজ যেটা মারকুইস স্ট্রিট সংলগ্ন অঞ্চল, সেখানে থিয়েটারের জগতের দেশি-বিদেশি নাট্যব্যক্তিত্ব থেকে কলাকুশলিরা থাকতেন। থাকতেন বিদেশি অতিথিরাও। ফলে পার্কস্ট্রিট কেন্দ্র করে বিদেশিরদের থাকার পরম্পরা কোনও নতুন নয়। বলা যায়, ঐতিহ্যেরই একাংশ। অতীত বা বর্তমান কোনো সরকারই তার পরম্পরা ভাঙতে চাননি।

ফলে এককালের ‘গোরস্থান কা রাস্তা’ বলে বাঙালিরা যতই নাক সিঁটকানো আচরণ করুক, বর্তমানে পার্কস্ট্রিট হলো কলকাতার সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ এক ও অদ্বিতীয় এলাকা। যার দু’ধারে গড়ে উঠেছে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, ফ্রিমেসনস হল, এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের মতো প্রতিষ্ঠানসহ অজস্র অতি উচ্চবিত্ত পরিবারের বাসভবন।

বড়দিন থেকে নতুন বছর, কলকাতাবাসী হুল্লোড় করে স্বাগত জানায় এখানে এসেই। হইহুল্লোড়ে ভরে ওঠে ওইকটা রাত। চারিদিকে সরকারি ব্যয়ে জ্বলে ওঠে ঝলমলে আলো। সেজে ওঠে রাস্তার দু’পাড়। পাশাপাশি শপিং এলাকা, কফি শপ, রেস্তোরাঁ, নাইটক্লাব, হোটেল, স্কুল, কলেজ, অফিস অর্থাৎ দিনভর ব্যস্ততার চাকা গড়িয়ে চলে এ পার্কস্ট্রিটে বুকেই। আর এর জেরে অতি দ্রুত গতিতে প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে ঐতিহ্যের পার্কস্ট্রিট।

বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শহর আধুনিকীকরণের কারণে ক্রমাগত ভাঙা হয়েছে পুরোনো বাড়ি, বদলে গেছে একাধিক স্থাপত্য। হয়তো, এমন দিন আসতেই পারে যখন মানুষ ভুলে যাবে পার্কস্ট্রিটের নাম। যেমন ভাবে মানুষ ভুলে গেছে এ পার্কস্ট্রিটের একসময় নাম ছিল বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২১
ভিএস/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।