ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

কলকাতা কি অবৈধ অর্থের আস্তানা?

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২২
কলকাতা কি অবৈধ অর্থের আস্তানা?

কলকাতা: আবারও কলকাতায় হান দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শনিবার কলকাতার তিনটি জায়গায় একযোগে তল্লাশি চালিয়েছে সংস্থাটি।

তিন জায়গার মধ্যে কলকাতার গার্ডেনরিচের এক পরিবহন ব্যবসায়ীর বাড়িতে মিলেছে টাকার পাহাড়। প্লাস্টিকে মুড়িয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ৫০০ ও ২ হাজার রুপির নোটের বান্ডিল। উদ্ধার হয়েছে ১৮ কোটি রুপি। অতর্কিত তল্লাশিতে মিলেছে এই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ। এর পাশাপাশি মোমিনপুর ও পার্ক স্ট্রিটের একটি বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি।

যদিও শনিবার গার্ডেনরিচ থেকেই উদ্ধার হয়েছে রাশি রাশি রুপি। ৫০০ ও ২ হাজার রুপির উদ্ধার হওয়া নোটের বান্ডিল গোনার জন্য ৮টি টাকা গোনার মেশিন আনা হয়েছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৮ কোটি রুপি গোনা হয়েছে বলে জানা যায়।

এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ওই অঞ্চলের পরিবহন ব্যবসায়ী নাসির খানের ছেলে আমির খান। তিনি কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। ভারতজুড়ে ‘ই নাগেট’ নামে একটি মোবাইল গেমিং অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন আমির খান। এই মোবাইল গেমিং অ্যাপে প্রতারণা করেই কোটি কোটি টাকা লুট হয়েছে বলে মনে করছে ইডি। তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন ইডি কর্তারা।

গত চার মাসে পশ্চিমবঙ্গের অবৈধ অর্থ উদ্ধার হওয়ার গ্রাফ দেখলে মনে হবে, কুবেরের খাজানা। এক সময় মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ ভারতে এসব খবর দেখতেই অভস্ত্য ছিল বাঙালি। এখন এগিয়ে বাংলা। মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি অভিযানেই শত শত কোটি রুপি উদ্ধার করেছে ভারতের তদন্তকারী সংস্থাগুলো। সব মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি রুপি!

শুরুটা হয়েছিল চলতি বছরের মে মাসে। গত ১৪ মে ইডি বড়সড় সাফল্য পায় বাংলাদেশি পি কে হালদারকে গ্রেফতার করে। বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পি কে হালদারের সাথেই ইডির হাতে গ্রেফতার হন তার আরও পাঁচ সহযোগী। বর্তমানে মোট ছয় জন আদালতে বিচারাধীন এবং জেল হেফাজতে রয়েছেন। এখনো পর্যন্ত ৩০০ কোটি রুপি মূল্যের বেশি সম্পত্তির হদিস পায় ইডি। এর মধ্যে রয়েছে ৬০ কোটি নগদ অর্থ, ৮৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, নামে-বেনামে প্রচুর জমি, বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান। এমনকি মালয়েশিয়া ও দুবাইতেও তাদের সম্মত্তির সন্ধান পেয়েছে ইডি।


এরপর ইডির জালে জড়িয়ে পড়েন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অভিনেত্রী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। জেরায় বিপুল অর্থের হদিস পায় ইডি। গত ২২ ও ২৭ জুলাই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অর্পিতার উত্তর ২৪ বেলঘরিয়া ও কলকাতার ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় ৫৫ কোটি ৪৩ লাখ রুপি, ছয় কেজি স্বর্ণের গহনা ও বার, রুপার মুদ্রাসহ প্রচুর সম্পত্তির দলিল। বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, গাড়ির যে তালিকা এখনও পর্যন্ত উঠে এসেছে, তার বাজারমূল্য কয়েকশ কোটি রুপির কম নয় বলে ইডির ধারণা। পাওয়া গেছে একাধিক ভুয়া কোম্পানি ও ১৮টি বেনামি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।

তবে শুধু ইডি নয়, রাজ্যজুড়ে চলছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিবিআই) তল্লাশি। ১১ আগস্ট ছিল ভারতে রাখিবন্ধন উৎসব। ওই দিনেই হাতে হাতকড়া পড়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের আরও এক হেভিওয়েট দাপুটে নেতা অনুব্রত মন্ডল। নগদ অর্থ মিলেছে মাত্র সাত কোটি রুপি। তবে তার ও পরিবারের যে সম্পত্তির সন্ধান তুলে আনছে সিবিআই, তা শত কোটি রুপির। তদন্ত চলার কারণে সঠিক তথ্য না উঠে এলেও অনুব্রত মন্ডলের সম্পত্তির মূল্য হাজার কোটি রুপি ছাড়াবে।

সিবিআই-এর আরও এক সাফল্য উত্তর ২৪ পরগনায়। ২ সেপ্টেম্বর ওই জেলার হালিশহর পুরসভার তৃণমূলের চেয়ারম্যান রাজু সাহানি গ্রেফতার হয় সংস্থাটির হাতে। সনমার্গ কো-অপারেটিভ চিটফান্ড সংস্থার দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত রাজু। উদ্ধার হয় নগদ ৮০ লাখ রুপি। সিবিআইয়ের দাবি, তার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির হদিস পাওয়া গিয়েছে। উদ্ধার হয়েছে একাধিক সম্পত্তির দলিল। পাশপাশি এই তৃণমূল কাউন্সিলরের নথি ঘেটে পাওয়া গেছে থাইল্যান্ডের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। যেখানে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ মজুদ রয়েছে বলে দাবি করেছেন সিবিআই কর্তারা। ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি পিস্তলও।

শুধু ইডি-সিবিআই নয়, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অতিসম্প্রতি ভারতের অন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কিংবা রাজ্য পুলিশের হাতেও গ্রেফতার হয়েছেন অনেকে। তাদের কাছ থেকেও উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি রুপি।

শনিবার (১০ সেপ্টম্বর) ইডির হাতে গ্রেফতার আমির খান কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের নগর উন্নয়ন ও আবাসন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের ঘনিষ্ঠ। যে কারণে আবার একবার অস্বস্তিতে মমতার দল। যদিও ১৮ কোটি রুপি উদ্ধারের পর ইডির এই অভিযান নিয়ে বেশ ক্ষুদ্ধ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।

তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার মদতপুষ্ট তদন্তকারী সংস্থাগুলো অভিযান করে বাংলায় ব্যবসায়ীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে বাংলার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

ফিরহাদ প্রশ্ন তোলেন, নীরব মোদি, মেহুল চোকসির মতো ব্যক্তিরা ৭ হাজার কোটি রুপি নিয়ে পালিয়ে গেছে, তাদের হিসাব কোথায়?

কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে নিশানা করে তৃণমূলের সংসদ সদস্য সৌগত রায় বলেছেন, এটাই তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কৌশল। যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই সেই রাজ্যের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান করে, ভয় দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতে কেউ তৃণমূল কংগ্রেসকে সাহায্য না করে। তবে এসব করেও কিছু করতে পারবে না।

বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকা সার্বিকভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অপরাধের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠছে। তা আবার প্রমাণিত হলো। শাসকদলের মদত না থাকলে এই ঘটনা ঘটতে পারে না।

অর্থ উদ্ধার প্রসঙ্গে সিপিআইএমের সাবেক সংসদ সুজন চক্রবর্তী বলেন, এটা লজ্জার বিষয়। বাংলার অধপতন গোটা ভারত দেখছে। যেখানে হাত দিচ্ছে সেখানেই কোটি কোটি অবৈধ টাকার পাহাড়। কালো টাকার রাজ্য হয়ে উঠেছে। নীতি, আদর্শ বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছে। যেখানে পারো লুটে নাও। একটা সময় এই রাজ্য সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল। আজ সেই রাজ্যে লুটেরারা রাজত্ব করছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১
ভিএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।