ঢাকা: মাত্র ৩০ পয়সায় একটা বিড়ি পাওয়া যায় বাংলাদেশে! এ পয়সায় অন্য কোনো কিছু পাওয়া যায় কিনা জানা নেই। ৩০ পয়সা রাস্তায় পড়ে থাকলে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সম্ভবত ভিক্ষুকও আজকাল ফিরে তাকায়না।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদশে এ সস্তা পণ্যটি দিন দিন আরো সস্তা হয়ে পড়ছে। ২০০৮-০৯ সালে নির্দিষ্ট সংখ্যক বিড়ি কিনতে মাথাপিছু দেশজ উৎপাদনের (Per capita GDP) যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হতো ২০১৩-১৪ সালে ওই একই সংখ্যক বিড়ি কিনতে মাথাপিছু দেশজ উৎপাদনের কম পরিমাণ ব্যয় করতে হয়েছে।
বিড়ির ভোক্তা মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের তামাকজনিত অসুস্থতা ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার সক্ষমতাও কম। তামাকের ছোবল থেকে জনগণকে বিশেষ করে গরিব জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে হলে তামাকের দাম অবশ্যই জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে বর্ধিত পরিমাণ সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধিই সবচেয়ে পরীক্ষিত পন্থা।
সুখের বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে তামাকপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের ব্যাপারে নিদের্শনা দিয়েছেন এবং একইসঙ্গে তিনি বাংলাদশে বিদ্যমান তামাক কর কাঠামো সহজীকরণের কথা বলেছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার তেমন কোনো প্রতিফলন চোখে পড়েনি। তবে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ও বিড়ির উপর করহার খানিকটা বাড়ানো হয়েছে, যা এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যবহার হ্রাসে সামান্য হলেও অবদান রাখবে।
তবে বিড়ির উপর প্রস্তাবিত করহার প্রত্যাহার করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং পরিতাপের বিষয় এক-দু’জন মন্ত্রীও (খুব সম্ভবত অজ্ঞতাবশত) এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কথা বলছেন।
বিড়ি শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার নামে মূলত এ খাতের ব্যবসায়ীদের পক্ষে নানা ধরনের হাস্যকর তথ্য-উপাত্ত এবং খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। তিনি বলছেন, ‘অসম রাজস্ব নীতির’ শিকার হচ্ছে বিড়ি। আমরাও তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত অসম কর নীতির (রাজস্ব নীতি) কারণেই বিড়ি ৩০ পয়সা, আর (দামি) সিগারেট ১৩০০ (১৩ টাকা) পয়সা।
আমরাও একক কর নীতি চাই, অসম নয়। যেখানে সব তামাকপণ্যের মূল্য একইরকম হবে। দাম বাড়লে ভোক্তা যেন অল্পদামি তামাকে যেতে না পারে। এতে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে তামাকের ব্যবহারও কাঙ্খিতহারে হ্রাস পাবে।
‘অসম রাজস্ব নীতির’ অন্য একটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তাহলো প্রস্তাবিত বাজেটে দামি সিগারেটে নামমাত্র ১ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রেও আমরা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একমত, আমরাও চাই দামি সিগারেটে করহার বাড়ানো হোক। তবে একইসঙ্গে বিড়িসহ সব তামাকপণ্যে আরো বেশি হারে সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপের পক্ষে আমরা। আমরা চাই সিগারেটের বিদ্যমান মূল্যস্তর প্রথা বিলুপ্ত করা হোক।
‘অসম রাজস্বনীতির’ আরো একটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তাহলো গরিব মানুষ যেসব পণ্য ভোগ করে সেগুলোর উপর কম কর আরোপ করা। খুব সম্ভবত এ ব্যাখাটি তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছ থেকে পেয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তামাকপণ্যকে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ হিসেবে কোড করে থাকে এবং আমাদের দেশের করকাঠামো মূলত প্রগ্রেসিভ যার মূল দর্শন বেশি আয় ও বেশি দামি পণ্যের ভোক্তারা বেশি কর দিবে, কম আয় ও অল্পদামি পণ্যের ভোক্তারা কম কর প্রদান করবে।
এখন প্রশ্ন হলো তামাকের ক্ষেত্রে এ প্রগ্রেসিভ করকাঠামো কি আদৌ প্রযোজ্য হবে? উল্টো এক্ষেত্রে রিগ্রেসিভ কর কাঠামো হওয়া উচিত। গরিব জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে হলে অবশ্যই এধরনের বিষপণ্য ক্রমশ: তাদের নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। বলা হয়ে থাকে ‘অসম রাজস্বনীতির’ পক্ষাবলম্বন করে বিড়ির ওপর কর আরোপ করা হলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ২৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে।
অথচ জরিপে দেখা গেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সবমিলিয়ে এ শিল্পে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা বড় জোর আড়াই লাখ, যার অর্ধেকই শিশু। যা শ্রম আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। পাশাপাশি বিড়ি কারখানায় কাজ করাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকাভুক্তও করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ ও মানবেতর।
প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এমন মানবেতর ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমকে আমরা করছাড় দেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করবো কিনা, যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বিনির্মাণ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?
বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৬
এসএইচ