ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

দেশে শুধুই পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক থ্রিজি!

সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১২
দেশে শুধুই পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক থ্রিজি!

বাংলাদেশে অবশেষে ধরা দিল বহুল প্রতীক্ষিত থ্রিজি নেটওয়ার্ক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী টেলিটক নিয়ন্ত্রিত থ্রিজির পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক ব্যবহারের কথা জানালেন সুস্পষ্টভাবেই।



এটা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। তবে প্রান্তীক মানুষের কিংবা দেশের রাজস্ব বাড়াতে এ প্রযুক্তি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে জনমনে অন্তহীন সংশয় তৈরি হয়েছে। এমনকি থ্রিজির অন্যতম বাহক তরুণ প্রজন্মের কাছেও এ সেবার দিকগুলো পরিস্কার নয়। অনেকে এ জন্য বিটিআরসির অদূরদর্শীতাকেই দুষছেন।

বিটিআরসির হিসাব মতে, বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ৯ কোটি ২৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা মাত্র ১২ লাখ। তবে থ্রিজির কারণে এ সংখ্যা ৬৫ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা আছে বিটিআরসির। আর টেলিটক নিয়ে সেবা এবং গ্রাহক সেবামান নিয়েও অনেক প্রশ্নই আছে।

এ মুহূর্তে দেশে মোবাইল অপারেটরের সংখ্যা ৬টি। কিন্তু অন্য অপারেটরদের থ্রিজি তরঙ্গ বরাদ্দ না দিয়ে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত্ব মোবাইল অপারেটর টেলিটকের মাধমে এ সেবা দেওয়াকে অনেকেই আপাতত আমলাতন্ত্রিক জটিলতা এবং একচেটিয়া মনোভাব হিসেবে দেখছেন।

৯ কোটির বেশি গ্রাহককে অনিশ্চয়তায় রেখে এ সেবার পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক ব্যবহারের উদ্বোধনকে বিশ্লেষকেরাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন। অর্থাৎ এখন থ্রিজি সেবা পেতে হলে টেলিটকের সিম কেনা এক অর্থে বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে টেলিটকের গ্রাহক হলেও হচ্ছে না।

থ্রিজি অ্যানাবল হ্যান্ডেসেট ছাড়া মোবাইল ফোনে থ্রিজি সেবা কোনোভাবেই উপভোগ করা যাবে না। দেশে এ মুহূর্তে ৫ ভাগ মানুষ থ্রিজি অ্যানাবল হ্যান্ডসেট ব্যবহার করেন। অর্থাৎ এটিও দেশে থ্রিজি সেবা সম্প্রসারণের একটি বড় ধরনের অন্তরায় হিসেবেই দেখছেন টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞেরা।

এ হিসাবে ১২ লাখ টেলিটক গ্রাহকের মধ্যে ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষের কতজনের থ্রিজি অ্যানাবল হ্যান্ডসেট আছে এ সংখ্যাও স্পষ্ট নয়। সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত তবে সম্ভাবনাময় অগ্রগতির পথে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত অনেকটাই দিকনির্দেশনাহীন।

এ জন্য বিটিআরসির একটি বিশেষ পরামর্শক কমিটির তৈরির তাগিদ দিয়েছেন টেলিকম সূত্রগুলো। এ ধরনের একটি সম্ভাবনাময় সেবাকে রিসার্চ, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (আরঅ্যান্ডডিআই) ছাড়াই বাজারে ছাড়া হলো। একসঙ্গে দুই বা ততোধিক অপারেটরকে এ সুযোগ না দেওয়ায় একে মার্কেট মনোপলি বলেও অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন। এর একটা নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি এবং টেলিযোগাযোগ খাতে।

অর্থের বিনিময়ে সেবা দিতে এত জটিলতাই বা কেন পোহাতে হবে গ্রাহকদের এ প্রশ্নের সদুত্তর নেই বিটিআরসির কাছে। এশিয়া মহাদেশে নেপালে থ্রিজি সেবার প্রথম প্রচলন হয়। নেপালে শিক্ষা এবং চিকিংসা খাতে এ সেবা বহুল ব্যবহৃত হয়।

থ্রিজির সফল ব্যবহার নিশ্চিত করতে কনটেন্ট সীমাবদ্ধতার কথা জানান দেশের মোবাইল অপারেটরদের বাজার বিশ্লেষকেরা। পর্যাপ্ত ই-কনটেন্ট ছাড়া এ ব্যয়বহুল সেবাকে বাণিজ্যিকভাবে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এমন শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেক টেলিযোগাযোগ বিশ্লেষক।

এ প্রসঙ্গে বেসিসের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং এখনই ডটকমের প্রধান নিবার্হী শামীম আহসান বাংলানিউজকে বলেন, থ্রিজির এ সূচনাকে স্বাগত। এ সেবার ফলে দেশে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত হবে।

তবে একে শুরুতেই অন্যসব অপারেটদের মধ্য দিলে সেবার সুফল আরো বেশি গ্রাহক একেসঙ্গে উপভোগ করতে পারতেন। ফলে অন্য অপারেটরদের এ সেবা বরাদ্দে দ্রুত আইনি জটিলতা নিরসনে বিটিআরসির কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করেন। থ্রিজির ফলে দেশীয় ই-কমার্স সুপ্রসারিত হওয়ার একটা দারুণ সুযোগ আছে। আর একে কাজে লাগাতে হলে দ্রুতই অন্য অপারেটদেরও এ সেবায় লাইসেন্স দেওয়া উচিত।

এ বছরের শেষনাগাদ থ্রিজি বিষয়ক নীতিমালা চূড়ান্ত হতে পারে। এমনটাই জানিয়েছে সরকারের বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। বিটিআরসি এসব বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য না দেওয়ায় জনমনে এসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

এদিকে টিভি এবং পত্রপত্রিকায় থ্রিজিভিত্তিক ব্যতিক্রমী আদলের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এ বিজ্ঞাপনের মূল বক্তব্য ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’। আসলে প্রশ্ন বাঁধটা কার। আর এটা কে ভাঙ্গবে। টেলিযোগাযোগ বিশ্লেষকেরা বলছেন এ বিজ্ঞাপন অস্পষ্ট। আর বাঁধ তো বিটিআরসির নিজের। সেটা ভাঙ্গার দায়িত্বটাও তাদেরই। তাই এ বিজ্ঞাপন আসলে কাদের উদ্দেশ্য নির্মিত। কারণ চাইলেই তো যেকোনো গ্রাহক থ্রিজির সেবা নিতে পারছেন না।

প্রসঙ্গত, গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে ইউটিউব বন্ধ। অর্থাৎ অনলাইনে ভিডিওনির্ভর যেকোনো সাইট দেখতে চাইলেও আপাতত টেলিটক থ্রিজি গ্রাহকেরা তা উপভোগ করতে পারবেন না। কারণ ইউটিউব বন্ধের কারণে বিশ্বের যেকোনো ঘটনার তাৎক্ষণিক ভিডিও টেলিটক থ্রিজির মাধ্যমে দেখা যাবে না।

অথচ থ্রিজি প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে মোবাইলে ভিডিও এবং সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচার সুবিধা উপভোগ। কিন্তু ইউটিউবের মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী অনলাইন ভিডিও মাধ্যমকে বন্ধ রেখে আসলে কি ধরনের বাঁধ ভাঙ্গার আহবান করা হচ্ছে। বাংলানিউজে ফোন করে এমন প্রশ্নের সদুত্তর চেয়েছেন অনেক পাঠকই।

এত বিপুল সম্ভাবনাময় এবং সরকারি রাজস্বের অন্যতম শক্তিশালী খাতকে এতটা বিবেচনাহীনভাবে বাজারে প্রকাশের জন্য বিটিআরসি কতটা দায়িত্বে পরিচয় দিয়েছে। এমন প্রশ্ন প্রযুক্তিপ্রেমীদের মনে বারবারই উঠে আসছে। অচিরেই টেলিটক গ্রাহক এবং সম্ভাব্য গ্রাহকেরা এসব প্রশ্নের তথ্যনির্ভর সদুত্তর প্রত্যাশা করেছেন।

প্রসঙ্গত, গত জুলাই মাসে বহুল প্রতীক্ষার অবসানে থ্রিজি সেবা দেওয়ার ঘোষণা দেয় টেলিটক। তখন সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় এটা নিবন্ধনের সূচনা পর্ব মাত্র। একটানা তিনমাস ‘গ্রাভিটি’ প্যাকেজের একটানা শর্ত পূরণ করলেই মিলবে থ্রিজি সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা। সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

এ মুহূর্তে টেলিটকের প্রতিটি প্রিপেইড গ্রাহক থ্রিজি সেবার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। তবে একটানা তিনমাসে তিন ধাপে ৫০০ টাকা করে নিবন্ধন ফি দিলেই এ সেবার নিবন্ধিত গ্রাহক হওয়া সম্ভব।

টেলিটকের থ্রিজি সেবাভুক্ত হতে প্রথমে মোবাইলে ৫০০ টাকা ব্যালেন্স নিশ্চিত করে (Gravity) লিখে ৬৬৬ নম্বরে এসএমএস (চার্জ প্রযোজ্য নয়) পাঠাতে হবে। এরপর নিবন্ধিত টেলিটক গ্রাহক গ্রাভিটি ক্লাবের সদস্য হবেন। তবে এখানেই শেষ নয়।

এরপর পরবর্তী আরো দুমাসে দুই কিস্তিতে ৫০০ টাকা করে ১ হাজার টাকা নিবন্ধিত ফি দিতে হবে। সব মিলিয়ে তিনমাসে দেড় হাজার টাকার নিবন্ধন ফি দিলেই থ্রিজি সেবার জন্য গ্রাভিটি ক্লাবের সদস্যপদ বহাল থাকবে।

তবে গ্রাভিটি ক্লাবের সদস্য হলে বান্ডল অফার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে পালস সুবিধা। সর্বমোট ৬০০ মিনিট টকটাইম সুবিধা। এ প্যাকেজে ৩০০ মিনিট অননেট আর ৩০০ মিনিট অফনেট টকটাইম প্রযোজ্য।

আর বোনাস অফারে থাকছে থ্রিজি গ্রাভিটি ক্লাবের গ্রাহক হওয়ার সুযোগ। এ ক্লাবের সদস্য হিসেবে সর্বোচ্চ রিচার্জকারীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে থ্রিজি সংযোগ দেওয়া হবে। আর গ্রাভিটি নিবন্ধিত প্রতিটি সদস্যই পাবেন ১ জিবি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ। এটি ৩০ দিন পর্যন্ত উপভোগ করা যাবে।

আপাতত এ সুযোগ শুধু ঢাকা, টঙ্গী, গাজিপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট এবং কক্সবাজার শহরের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। আরও বিস্তারিত জানতে (১২৩৪) এ নম্বরে কথা বলতে পারবেন। থ্রিজির প্রচারণায় এমন সব তথ্যই দিয়েছে টেলিটক। এ ছাড়াও আগ্রহীরা (www.teletalk.com.bd) এ সাইটেও তথ্য পাবেন।

বাংলাদেশ সময় ১৮২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।