ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

আইটিইউ: সরকারই ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রক

সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১২
আইটিইউ: সরকারই ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রক

বিশ্বের ভেতর আরেক বিশ্ব। নতুন এ বিশ্বের নাম ‘ইন্টারনেট’।

এ বিশ্ব তৈরি করেছেন ভিন্ট কার্ভ। তাকেই ‘ফাদার অব দ্য ইন্টারনেট’ বলা হয়। তবে এ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে ১৯৩টি দেশের সরকার এখন মরিয়া।

বিশ্বের প্রায় প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এ বিশ্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সুদীর্ঘ সময়ের নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে এ বিশ্ব। এমনকি নানা অজুহাতে এ সক্রিয় সদস্যদের আইনি জালেও বন্দি করা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার জনগণের অধিকার তোয়াক্কা না করে যেকোনো সাইট বন্ধ করে দিচ্ছেন।

এ নিয়ে আবার সরকার এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অভিযোগও আছে। কোনো কোনো মাধ্যম যেমন ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার এসব বহুল জনপ্রিয় সামাজিক গণমাধ্যম রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় সরকারকে নানামুখী চাপে ফেলছে।

এ মুহূর্তে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে চলছে ইন্টারনেট বিশ্বের ভবিষ্যৎ ভাগ নির্ধারণের মতবিনিময়। তবে নিয়ন্ত্রণ যে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ সরকারের হাতেই থাকছে তা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে।

এ সম্মেণনে অংশ নেওয়া ১৯৩টি দেশের কোনো সরকারই ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে প্রস্তুত নয়। বরং কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আরও সোচ্চার হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অপপ্রচারর ঠেকাতে ইন্টারনেটে ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এমনটাই বলছেন অংশ নেওয়া দেশগুলোর সরকারি প্রতিনিধিরা।

যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এখন সরকারি নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রতিটি দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনার ওপর কব্জা প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে মুক্তমত চর্চার অবাধ ক্ষেত্রটি ক্রমেই গণবিমুখ হয়ে পড়তে যাচ্ছে। এতটা নিয়ন্ত্রণ আর আইনি বিধিনিষেধ থাকলে সাধারণ মানুষের জনমত প্রকাশে এ জনপ্রিয় মাধ্যমটি কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।

অথচ ইন্টারনেট প্রতিটি দেশের সরকারকে আরও বেশি জনপ্রিয় আর গণবান্ধব করে তুলতে পারে। এ ধারণা কোনো সরকারই মানতে নারাজ। এ নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য বড় ধরনের অন্তরায়। এমনই মন্তব্য করেছেন ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞেরা।

এরই মধ্যে দুসপ্তাহের এ নীতিনির্ধারনী সম্মেলনের মূল সিদ্ধান্ত প্রায় সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রচলিত আইনের তেমন কোনো পরিবর্তনই আসছে না এ সম্মেলন থেকে। তাই ইন্টারনেপ্রেমীদের জন্য আদ্যেও কোনো সুখবর আশার নিশ্চয়তা নেই।

প্রসঙ্গত, আর্টিকেল ৩৪ এর ধারা মতে, আইটিইউয়ের প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র জনস্বার্থে ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আইনি অধিকার প্রয়োগে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। রাষ্ট্রের সুব্যবস্থা, আইন এবং গণতন্ত্র ঝুঁকিপূর্ণ হয় এমন আশঙ্কায় কোনো রাষ্ট্রই এ নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে পারবে না। অর্থাৎ ইন্টারনেটে মুক্তচর্চার কারণে কোনো সহিংসতা ঘটতে তার দায় ওই দেশের সরকারকেই নিতে হবে। এমন কথাই দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন আইটিইয়ের মহাসচিব হামাদুন টুর।

ফলে ইন্টারনেটের অবাধ ভবিষ্যৎ আবারও সরকারি নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে আটকে পড়ল। এখানে জনমত, বৈশ্বিক যোগাযোগ এবং সাধারণ মানুষের মত প্রতিষ্ঠায় সব ধরনের সুযোগকেই উপেক্ষা করল আইটিইউ।

এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড টেকনোলজির নীতিনির্ধারক ইমা ল্যানসো জানান, ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনাকে টেলিযোগাযোগের মতো করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে। এতে অবাধ তথ্যপ্রবাহ বিঘিœত হবে। প্রাইভেসির দোহাই দিয়ে একে আসলে নিয়ন্ত্রণেই নেওয়া হলো। ফলে ইন্টারনেট ধারণারই অপমৃত্যু হলো।

সরকারগুলোকে আরও সক্রিয় আর গণবান্ধব হতে সবচেয়ে কার্যকর ইন্টারনেট। অথচ এ সত্যকে অনুধাবন না করেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই মূখ্য হয়ে উঠেছে এ সম্মেলনে। এখানে সাধারণ মানুষের তথ্য অধিকারের কথা একেবারেই ঠাঁই পাচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, এর আগে ১৯৮৮ সালে এ ধরনের সম্মেলনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পায়। অথচ ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো একই নিয়মে ইন্টারনেট বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হবে। এটা কেমন নীতি। এতটা সময়ে পুরো বিশ্বের আর্থসামাজিক চেহারাই বদলে দিয়েছে প্রযুক্তি আর ইন্টারনেট। তবে কেন এ অযাচিত কব্জা। এমন প্রশ্ন প্রতিটা সাধারণ নাগরিকের।

সাইবার নিরাপত্তার অজুহাতে তথ্যযুদ্ধের আশঙ্কায় এমনটা করা হচ্ছে সম্মেলনে অংশ নেওয়া শীর্ষ দেশগুলোর নেতারা মত দিয়েছেন। এটা কি গণমত বিমুখ আচরণ নয়। আলোচনায় বসে যেন নিয়ন্ত্রণকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

ডিজিটাল রাইট গ্রুপ অ্যাকসেসের নির্বাহী পরিচালক ব্রেট সলোমন জানান, একমুখী তথ্য দিয়ে এখানে ইন্টারনেট অধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। জনগণের প্রতিটি সমালোচনার জবাব দিতে সরকার আইনগত বাধ্য। অথচ সমালোচনার ভয়ে গণবিমুখ আচরণ করে গণতন্ত্রেও চর্চার কিভারে নিশ্চিত হবে তা সুস্পষ্ট নয়।

সরকারের অধিভুক্ত সংস্থাগুলো ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে পরোক্ষভাবে ইন্টারনেট সরকার নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। অবাধ তথ্য আর মতবিনিময়ের সুয়োগটা তাহলে কোথায়। এমন প্রশ্ন উঠেছে এ সম্মেলনে।

একটি নীতিগত সিদ্ধান্তে সরকারি, বেসরকারি এবং সভ্য সমাজের নাগরিকদের সম্বনিত মতামত শুনতে হবে। এরপরই একটি সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য ইতিবাচক হবে। অথচ এখানে শুধু সরকারের নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। এমন নিয়ন্ত্রণে নাগরিক সমাজের কতটা অধিকার বঞ্চিত হবে তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

এ সম্মেলনে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, অধিকার আর করপোরেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা  স্থান পাচ্ছে না। ফলে গণমানুষের জন্য ইন্টারনেট ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। ফলে ব্যক্তি অথনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কথাগুলো জানালেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের মুখপাত্র টেরি ক্রামার।

তবে ইন্টারনেটের ব্যবহারিক ফি বাড়ানো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেট ব্যয়বহুল মাধ্যমে পরিণত হবে। এটি করপোরেট দুনিয়ার ব্যবসা সম্প্রসারণ আর পণ্য প্রচারেই অধিক কার্যকর হবে। জনমত কিংবা ভিন্ন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরিভাবে ব্যাহত করবে। এমন নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সাইবার বিপ্লবের আশঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এবারের ডব্লিউসিআইটি সম্মেলন ঘিরে নানমুখী জনপ্রত্যাশা থাকলেই শেষ পর্যন্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণেই বলবৎ হচ্ছে ইন্টারনেটের জন্য। এতে ভবিষ্যৎ বিশ্বে ইন্টারনেটের চাহিদা বাড়লেও প্রাপ্তী আর ব্যবহারের প্রশ্নটা আরও জটিল হচ্ছে। এটা গণবান্ধব না গণবিমুখ নিয়ন্ত্রণ এ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞেরা।

বাংলাদেশ সময় ১৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।