জেট বিমানের সফটওয়্যার বর্তমানে আরো নিরাপদ করা খুব জটিল হলেও ভবিষ্যতে তা সম্ভব হবে। আরো বহুদুরের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
কম্পিউটিং হয় গনিতের ভাষায়। বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর মতে গনিত হলো মহাবিশ্বের ভাষায়। গ্যালিলিওর উক্তিটি নিম্নরূপ-
“Philosophy is written in that great book which continually lies open before us (I mean the Universe). But one cannot understand this book until one has learned to understand the language and to know the letters in which it is written. It is written in the language of mathematics, and the letters are triangles, circles and other geometric figures. Without these means it is impossible for mankind to understand a single word; without these means there is only vain stumbling in a dark labyrinth.”
-Galileo Galilei
“দর্শনশাস্ত্র সেই মহান বইয়ে লেখা যা সর্বদা আমাদের (মহাবিশ্বের) সামনে উন্মুক্ত। কিন্তু এই বইটি একজন ততক্ষন বুঝতে সক্ষম হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে এই বইয়ের ভাষা এবং বর্ণমালা বুঝতে পারবে। এটি লেখা হয়েছে গনিতের ভাষায়, এবং বর্ণমালাগুলো হলো ত্রিভুজ, বৃত্ত এবং অন্যান্য জ্যামিতিক আকৃতিসমূহ। এগুলো (বর্ণমালা) না বুঝলে মানবজাতির পক্ষে একটি শব্দ বোঝাও সম্ভব নয়; এগুলো না বোঝার অর্থ অন্ধকার গোলকধাঁধায় ব্যর্থভাবে হোঁচট খাওয়া। ”
- গ্যালিলিও গ্যালিলি।
মহান ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ গ্যালিলিওর উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গনিতের ভাষায় এই মহাবিশ্বকে অনুধাবন করতে হবে। বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং কম্পিউটিং ক্ষমতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আধুনিক কম্পিউটার এত বেশি কম্পিউটেশন ক্ষমতাসম্পন্ন যে আমাদের হাতের স্মার্টফোনের কম্পিউটেশন ক্ষমতা ১৯৬৯ সালের “নাসা” এর সকল কম্পিউটারের ক্ষমতা থেকে বেশি। সেই সময়ের নাসার কম্পিউটারগুলোর মেমোরি ছিল মেগাবাইটের ঘরে, আর সেগুলো দ্বারা সেকেন্ডে কয়েক লক্ষ “অ্যাডিশন অপারেশন” বা যোগ করা যেত। অপরপক্ষে বর্তমান অনেক স্মার্টফোনের র্যাম (র্যানডম অ্যাকসেস মেমোরি) ৩ গিগাবাইট এবং এই স্মার্টফোনগুলো সেকেন্ডে কয়েক মিলিয়ন অ্যাডিশন অপারেশন করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, আমরা এতো প্রসেসিং ক্ষমতাসম্পন্ন ডিভাইস অতীতের তুলনায় অনেক কম দামে কিনতে পারছি। যার ফলে সাধারন মানুষের ঘরে ঘরে, এমনকি হাতে হাতে ক্ষুদ্র আকৃতির কম্পিউটার পৌঁছে গেছে। কিন্তু কিভাবে আধুনিক প্রযুক্তির পক্ষে এত ক্ষুদ্র, ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সম্ভব হলো? প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ রূপই বা কেমন হবে?
আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি যে, বর্তমানে কম্পিউটারের মাঝে থাকা চিপ বা মাইক্রোপ্রসেসরগুলোর আকার চালের দানার মতই ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। এই ক্ষুদ্রাকৃতির চিপের মাঝেই রয়েছে বিলিয়ন সংখ্যক ট্রানজিস্টর। বর্তমানে ইন্টেলের ফোর্থ জেনারেশন কম্পিউটারের চিপে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা প্রায় ১.৭ বিলিয়ন। শুধু তাই নয়, ইন্টেলের মতে ২০২৬ সালের মধ্যে চিপে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা মানুষের মস্তিস্কের নিউরনের সংখ্যার সমান হবে। মানুষের নিউরনের সংখ্যা প্রায় ১০০ বিলিয়ন।
১৯৬৫ সালে ইন্টেল কর্পোরেশনের কো-ফাইন্ডার প্রফেসর গর্ডন মুর প্রযুক্তির আধুনিকায়নের এক ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করেন। কম্পিউটার তৈরি হয় বিভিন্ন চিপ বা মাইক্রোপ্রসেসর দ্বারা এবং এই চিপের মাঝে থাকে অসংখ্য ট্রানজিস্টর। প্রফেসর মুর সেই সময় লক্ষ্য করেন যে প্রতি ১৮ মাসে একটি মাইক্রোপ্রসেসরে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে থাকে। অর্থাৎ ট্রানজিস্টরের আকৃতি সময়ের সাথে সাথে ক্ষুদ্র হতে থাকে। এই ক্ষুদ্রাকৃতির ট্রানজিস্টর চিপের প্রসেসিং ক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি করে তেমনই এর দামও অতীতের তুলনায় কমিয়ে দেয়। তবে এখানেই ব্যাপারটা শেষ হয় না। ট্রানজিস্টর ক্ষুদ্র হতে হতে এতই ক্ষুদ্র হতে চলেছে যে খুব শীঘ্রই একেকটি ট্রানজিস্টরের আকার প্রায় পরমাণুর আকৃতির সমান হতে চলেছে। যার ফলে কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে দেখতে হচ্ছে আমাদেরকে, কারন কোন বস্তু যখন পরমাণুর পর্যায়ে চলে যায় তখন সেটি আর আমাদের চিরচেনা দৈনন্দিন জীবনের অন্য সকল বস্তুর মত একই নিয়মে পরিচালিত হয় না। পরমাণুর মত অতি ক্ষুদ্র আকৃতির কনাগুলো অনুসরণ করে “কোয়ান্টাম ফিজিক্স” এর নিয়মকানুন। আমাদের পরিচিত ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সে যেসব জিনিস অসম্ভব বলে মনে হবে সেরকম বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য কোয়ান্টাম ফিজিক্সে আছে। যেহেতু ট্রানজিস্টরগুলো অতি ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকানুন মেনে চলবে, তাই এমন ট্রানজিস্টর দ্বারা তৈরি কম্পিউটারের পক্ষেও অদ্ভুতুড়ে অনেক কিছু করা সম্ভব হবে যা বর্তমান কম্পিউটারের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলবে বলে ভবিষ্যতের এই কম্পিউটারগুলোকে বলা হবে “কোয়ান্টাম কম্পিউটার”।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে বোঝার আগে আমাদেরকে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কিছু ভিত্তি সম্পর্কে পরিচিত হতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো পরমাণুর মাঝে থাকা অতি ক্ষুদ্র কণার (যেমন ইলেক্ট্রন) মাঝে পরিলক্ষিত হয়। কম্পিউটারে সকল তথ্য বা হিসাব হয় বিট আকারে। বিট হলো শূন্য (০, অফ/ফলস) এবং এক (১, অন/ট্রু) এর নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের বিট যা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের নিয়ম মেনে চলতে পারবে। এই নিয়মগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো সুপারপজিশন, এনট্যাঙ্গলমেন্ট এবং প্যারালালিজম। যেহেতু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিটগুলো, তাই এদেরকে বলা হয় “কিউবিট” (Qubit)। কিউবিট আমাদের সাধারন বিটের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। কেন এটি বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হবে তা বোঝার জন্য আমরা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সুপারপজিশন, এনট্যাঙ্গলমেন্ট এবং প্যারালালিজমের সাথে পরিচিত হই –
সুপারপজিশন: কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেশনে বিজ্ঞানী নিলস বোর এই তত্ত্ব দেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী একটি পার্টিকেল বা পারমাণবিক কণাকে যেভাবে পরিমাপ করা হবে সেটি সেরকমই হবে। অর্থাৎ একটি পার্টিকেল কণা এবং তরঙ্গ দুই রুপেই থাকে। যখন একে পরিমাপ করা হয় তখনই এটি একটি অবস্থা ধারন করে। এই বিস্ময়কর তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখছি বা পরিমাপ করছি, ততক্ষন পর্যন্ত সকল কণা তাদের সম্ভাব্য সকল অবস্থাতেই বিরাজমান থাকে। যখনই আমরা দেখি বা পরিমাপ করি, তখন এটি সকল সম্ভাবনা থেকে মাত্র একটিতে পরিনত হয়। এই তত্ত্বের সমর্থনে “ডাবল স্লিট” নামক একটি বিখ্যাত পরীক্ষা করা হয়েছে যার মাধ্যমে ইলেকট্রনের সুপারপজিশনের প্রমান পাওয়া গেছে।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সুপারপজিশন নিয়ে অদ্ভুত এক তাত্ত্বিক পরীক্ষা রয়েছে যাকে বলা হয় “শ্রডিঞ্জারের বিড়াল পরীক্ষা” (Schrödinger’s cat experiment)। বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী শ্রডিঞ্জার (Schrödinger) তার এই কাল্পনিক পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেন যে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সুপারপজিশন আমাদের চিরচেনা জগতে কতটা অবিশ্বাস্য বলে প্রতিয়মান হয়। এই পরীক্ষা থেকে দেখা যায় যে আমরা পরিমাপ না করা পর্যন্ত শ্রডিঞ্জারের বিড়াল একই সাথে জীবিত এবং মৃত অবস্থায় থাকে!
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিট যেহেতু কোয়ান্টাম ফিজিক্সের নিয়ম মেনে চলে তাই এর মাঝেও সুপারপজিশন থাকবে। যার ফলে কিউবিটের পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব হবে যা আমাদের পরিচিত বিটের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। সুপারপজিশনের ফলে পার্টিকেল তার সম্ভাব্য সকল অবস্থাতেই থাকে। একইভাবে কিউবিটও তার সকল সম্ভাব্য অবস্থানে একই সাথে থাকতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ একটি কিউবিট একই সাথে শূন্য এবং এক হতে পারবে! যার ফলে অল্প সংখ্যক কিউবিটের পক্ষেই অনেক বেশি কম্পিউটেশন করা সম্ভব। যদি কোন কোয়ান্টাম কম্পিউটারে n সংখ্যক কিউবিট থাকে, তাহলে সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে এক ধাপে 2n সংখ্যক কম্পিউটেশন করা সম্ভব। যদি কিউবিটের সংখ্যা 500 হয় তাহলে সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে এক ধাপেই 2500 কম্পিউটেশন করা সম্ভব। এটি কত বড় সংখ্যা তা কল্পনা করা কঠিন। গোটা মহাবিশ্বের যতটুকু অংশ আমাদের পরিচিত তার মাঝেও 2500 সংখ্যক পরমাণু নেই। আমাদের সুপার কম্পিউটারের পক্ষেও যা করা সম্ভব নয় সেটা করতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বুঝতে কষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ নিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জনক হিসাবে পরিচিত রিচার্ড ফেইনম্যানের
একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে –
“No, you’re not going to be able to understand it. . . . You see, my physics students don’t understand it either. That is because I don’t understand it. Nobody does. ... The theory of quantum electrodynamics describes Nature as absurd from the point of view of common sense. And it agrees fully with an experiment.”
- Richard Feynman.
“না, তুমি এটা (কোয়ান্টাম ফিজিক্স) কখনই বুঝতে সক্ষম হবে না। … আসলে, আমার ফিজিক্সের ছাত্ররাও এর কিছুই বুঝতে পারেনি। এর কারন আমি নিজেই এটা বুঝতে পারিনি। কেউই পারবে না… কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স থিওরি প্রকৃতিকে আমাদের সাধারন বুদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে অযৌক্তিক প্রতীয়মান হয় এবং এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। ”
-রিচার্ড ফেইনম্যান।
প্যারালালিজম: সুপারপজিশনের ফলে কিউবিট একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে একই সঙ্গে একাধিক প্রসেসিং করা সম্ভব। এই ঘটনাকে বলা হয় প্যারালালিজম। আমাদের বর্তমান ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষেও প্যারালাল প্রসেসিং সম্ভব, তবে সে ক্ষেত্রে কম্পিউটারে একাধিক প্রসেসর প্রয়োজন হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে একটি প্রসেসরের পক্ষেই প্যারালাল প্রসেসিং করা সম্ভব হবে। যার ফলে এটি হবে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।
এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট: এই ঘটনাকে বলা হয় “টুইন বেবি ইফেক্ট”। সিনেমা বা গল্পে দেখানো হয় যে যমজ ভাই বা বোনদের একজনকে ব্যথা দিলে বা একজন বিপদে পড়লে অপরজন বহুদূরে থাকলেও তা টের পেয়ে যায়। পার্টিকেল বা কণার ক্ষেত্রে এটি বাস্তব। ধরে নেই যে দুটি “যমজ” পার্টিকেল একে অপরের থেকে বহুদূরে রয়েছে। যেহেতু তাদেরকে পরিমাপ করা হয়নি তাই সুপারপজিশন অনুযায়ী তারা তাদের সম্ভাব্য সকল অবস্থাতেই রয়েছে। কিন্তু যখনই আমরা এদের যেকোনো একটিকে পরিমাপ করবো তখন সাথে সাথে অপর “যমজ” পার্টিকেলের বৈশিষ্ট্যও নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ একজনকে পরিমাপ করা হলেই আমরা অপরজনের অবস্থা পরিমাপ না করেই জানতে পারবো। এক্ষেত্রে পার্টিকেল দুটির মাঝে দূরত্ব কোন ব্যাপার নয়। তারা যত দুরেই থাকুক না কেন, একটি পার্টিকেলের অবস্থা নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে অপরটিও নির্দিষ্ট অবস্থায় চলে আসে।
আইনস্টাইন ১৯৩৫ সালে পার্টিকেলের এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের ধারণা উপস্থাপন করেন। তিনি আর তার দুই সহযোগী পোডোলস্কি (Podolsky) এবং রোসেন (Rosen) মিলে একটি প্যারাডক্স বা ধাঁধা তৈরি করেন যা তাদের নাম অনুযায়ী EPR Paradox হিসাবে পরিচিত। তাদের পরীক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল কোয়ান্টাম সিস্টেমের অসঙ্গায়িত প্রকৃতিকে খন্ডায়িত করা। তাদের পরীক্ষার ফলাফল থেকে মনে হয়েছিল যে কোয়ান্টাম সিস্টেমে পরিমাপ করার আগেই নিজস্ব অবস্থা থাকে, যা সুপারপজিশন তত্ত্বের পরিপন্থী। যদিও পরবর্তীতে তাদের পরীক্ষার মূল ফলাফল ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু এই পরীক্ষার আরেকটি ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যাকে আমরা আজ এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট বলি।
এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট বলতে বোঝায় দুটি পার্টিকেল পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে দূরত্ব কোন বাধা নয়। পার্টিকেলগুলো ঠিক তথ্য আদান-প্রদান করে না, তবে তাদের পরিমাপ করার পর প্রাপ্ত ফলাফলে কোরিলেশন পাওয়া যায়। এই ঘটনা ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স দিয়ে উপলব্ধি করা কঠিন। দুটো পার্টিকেলকে এন্ট্যাঙ্গল করার জন্য আগে তাদেরকে একত্রিত বা Interact করতে দেওয়া হয় এবং তারপর তাদেরকে আলাদা করা হয়। এই এন্ট্যাঙ্গলড পার্টিকেলদুটোর মাঝে দূরত্ব যতই হোক না কেন তাদের একটির কোন বৈশিষ্ট্য, যেমন গতি পরিমাপ করা হলে সাথে সাথে আমরা অপর পার্টিকেলটির গতি পরিমাপ না করেই গনিত এবং পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানতে পারব। দুটি কিউবিট এন্ট্যাঙ্গল হয়ে থাকলে তাদের একটি পরিমাপ করা হলেই অপরটির ফলাফল আমরা জানতে পারবো।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন: এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট নিয়ে কাজ করার সময়ে আইনস্টাইন বুঝতে পারেন যে তাত্ত্বিকভাবে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন সম্ভব। যদিও তিনি এই ঘটনাকে উল্লেখ করেন “spooky action at a distance” হিসাবে। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের মূল তত্ত্ব হলো যে পার্টিকেলের অবস্থা বা state এর তথ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো সম্ভব যার ফলে অপর স্থানে সেই একই অবস্থার আরেকটি পার্টিকেল গড়ে উঠবে। অর্থাৎ এখানে বস্তুকে টেলিপোর্ট করা হচ্ছে না বরং তার অবস্থা (যেমন- ইলেকট্রনের স্পিন, ফোটনের পোলারাইজেশন ইত্যাদি) টেলিপোর্ট করা হচ্ছে। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের বেশ কিছু বাধা রয়েছে যার মাঝে অন্যতম হলো “Scanning phase” বা তথ্য গ্রহণ করার ধাপ। কোন পার্টিকেলের অবস্থা বা state এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠাতে হলে আগে সেই কণার অবস্থা আমাদেরকে জানতে বা পরিমাপ করতে হবে। কিন্তু হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি (Heisenberg's uncertainty principle) থেকে আমরা জানতে পারি যে কোন কণার অবস্থান এবং ভরবেগ একই সাথে নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব নয়। তাই আমরা পার্টিকেলের সকল তথ্য পাই না বরং কিছু তথ্য পাই। এই সমস্যাকে সমাধান করতে হলে গাণিতিক কোরিলেশনের মাধ্যমে অজানা তথ্যের ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
রিভার্সিবল সিস্টেম: কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বুঝতে হলে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের গঠন অর্থাৎ হার্ডওয়্যার সম্পর্কেও সাধারন ধারণা নিতে হবে। যেকোনো কোয়ান্টাম সিস্টেম রূপান্তরিত হওয়ার সময় এটি সর্বদা “রিভার্সিবল” থাকে। অর্থাৎ আমরা ফলাফল দেখে বুঝতে পারবো যে তার আদি রূপ কি ছিল। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের লজিক গেট এবং সার্কিট রিভার্সিবল হতে হবে অর্থাৎ তাদের ইনপুট বিট এবং আউটপুট বিটের সংখ্যার অনুপাত সমান হতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে রিভার্সিবল গেট দিয়ে কম্পিউটার বানানো হলেই তা কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়ে যাবে।
ইতিহাস: কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে গবেষণা শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে প্রফেসর রিচার্ড ফেইনম্যান কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স নিয়ে বিখ্যাত তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যার ফলে তাকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে চার্লস বেনেট দেখান যে রিভার্সিবল গেটের মাধ্যমে রিভার্সিবল কম্পিউটেশন করা সম্ভব। সেই একই সালে অ্যালেক্সান্ডার হোলেভো তার এক পেপারে দেখান যে n কিউবিটের পক্ষে n সংখ্যক ক্লাসিক্যাল বিটের চেয়ে বেশি তথ্য বহন করা সম্ভব নয়। একে বলা হয় হোলেভোর তত্ত্ব (Holevo's theorem)। পোলিশ গনিতবিদ রোমান ইনগার্ডেন ১৯৭৫ সালে “কোয়ান্টাম ইনফর্মেশন থিওরি” নামক এক পেপার উপস্থাপন করেন। ১৯৮০ সালের দিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে কাজ গতি পেতে থাকে। এই সময়ে ইউরি ম্যানিন কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ধারণা উপস্থাপন করেন। ১৯৮১ সালে রিচার্ড ফেইনম্যান MIT তে দেওয়া এক বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে কোয়ান্টাম সিস্টেমের রূপান্তর বা evolution সিমুলেট করে দেখা প্রায় অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের একটি বেসিক মডেল উপস্থাপন করেন যা এমন সিমুলেশন করতে সক্ষম হবে। সেই একই সালে টমাসো টফোলি তার রিভার্সিবল “টফোলি গেট” আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে David Deutsch ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডে সর্বপ্রথম “ইউনিভার্সাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার” এর বিবরণ দেন। আমাদের ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারকে বলা হয় “টুরিং মেশিন” এবং ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিনের মাধ্যমে অন্য যেকোনো টুরিং মেশিনকে সিমুলেট করা সম্ভব। একইভাবে ইউনিভার্সাল কোয়ান্টাম মেশিনের পক্ষে যেকোনো কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে সিমুলেট করা সম্ভব।
১৯৯৪ সালে নিউ জার্সির AT&T's Bell Labs এ কর্মরত পিটার শোর কিউবিটের সুপারপজিশন এবং এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ব্যবহার করে যেকোনো পূর্ণ সংখ্যার মৌলিক উৎপাদক (Prime factor) নির্ণয়ের আধুনিক উপায় বের করেন যাকে বলা হয় শোরের অ্যালগরিদম। তাত্ত্বিকভাবে এই অ্যালগরিদম কোন কোয়ান্টাম কম্পিউটারে প্রয়োগ করা হলে তা আমাদের পরিচিত যেকোনো কম্পিউটারের চেয়ে বহুগুণ বেশি দক্ষতায় কাজ করতে সক্ষম হবে। শোরের এই আবিষ্কারের ফলে অনেক কম্পিউটার সাইন্টিস্ট এবং পদার্থবিদরা নতুন আগ্রহে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের The National Institute of Standards and Technology এবং California Institute of Technology যৌথভাবে পরিবেশের বাহ্যিক প্রভাব থেকে কোয়ান্টাম সিস্টেমকে রক্ষা করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যেখানে চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করা হয়। তবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মাত্র কয়েক কিউবিটের কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব। সেই কিউবিটগুলো খুব দ্রুত তাদের “সুসঙ্গতি” (Coherence) হারাতে থাকে। ১৯৯৬ সালে একটি গবেষক দল উল্লেখিত একই লক্ষ্য সাধনের জন্য উন্নত একটি উপায় বের করেন যেখানে চৌম্বকক্ষেত্রের বদলে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স (NMR) ব্যবহার করা হয়। বেল ল্যাবরেটরির লভ গ্রোভারের আবিষ্কৃত “কোয়ান্টাম ডাটাবেজ সার্চ অ্যালগরিদম” ব্যবহার করা হয় এই কম্পিউটারে। ১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম ২ কিউবিট কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জোনাথন জোনস এবং মাইকেল মোসকা। সেই সালে তৈরি হয় ৩ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং গ্রোভারের অ্যালগরিদমের প্রয়োগ করা হয় NMR কম্পিউটারে। বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা চলছে। D-Wave Systems ২০০৯ সালে ১২৮ কিউবিটের কম্পিউটার চিপ বানাতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করেছে। ২০১১ সালে ডি-ওয়েভ সিস্টেম প্রথম কমার্শিয়াল কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করে যার নাম ডি-ওয়েভ ওয়ান। ২০১৪ সালে Kavli Institute of Nanoscience এর বিজ্ঞানীরা সফলভাবে ১০ ফিট দূরত্বে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন করতে সক্ষম হন। ২০১৭ সালে ডি-ওয়েভ ২০০০কিউ বের করা হয় যাতে দুই হাজার কিউবিট রয়েছে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর চ্যালেঞ্জ: কোয়ান্টাম কম্পিউটার গঠন করা এবং তাকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে বেশ কিছু বাধা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের মাঝে অন্যতম হলো কোয়ান্টাম অসঙ্গতি (Quantum decoherence)। কোন কোয়ান্টাম সিস্টেম যদি কোয়ান্টম সঙ্গতি বা কোহেরেন্স বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে তাহলে তাকে বলে ডিকোহেরেন্স। কোহেরেন্স বলতে বোঝায় কোন কোয়ান্টম সিস্টেমের কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যগুলো (যেমন- সুপারপজিশন) বজায় রাখার ক্ষমতা। কোয়ান্টাম সিস্টেম যতক্ষণ পর্যন্ত না বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে আসছে, ততক্ষন পর্যন্ত এটি তার কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় রাখতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ একটি ইলেকট্রন যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিবেশের আরো অসংখ্য পার্টিকেলের সংস্পর্শে আসছে, ততক্ষন পর্যন্ত এটি সুপারপজিশন, এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট, কোয়ান্টাম ট্রান্সপোর্টেশন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারবে। কিন্তু যখনই কোয়ান্টাম সিস্টেম পরিবেশের সংস্পর্শে আসবে, তখন থেকেই এটি তার কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যগুলো হারাতে থাকবে এবং ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের নিয়ম মেনে চলবে। ডিকোহেরেন্স কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা কারন কিউবিট তার সুপারপজিশনের মত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলতে থাকলে তখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে না। তাই কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে পরিবেশ থেকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিজ্ঞানী মাইকেল নেইলসন এবং ইসাক চুয়াংয়ের মতে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বাস্তব প্রয়োগের জন্য ন্যুনতম চারটি প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে হবে- Qubit implementation, Control of unitary evolution, Initial state preparation (qubits) এবং Measurement of the final state(s)। এদের মাঝে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো কিউবিট ইমপ্লিমেন্টেশন। কিউবিটকে বিভিন্ন উপায়ে প্রয়োগ করা যায়- স্পিন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী (spin state), গ্রাউন্ড বা এক্সাইটেড স্টেট অনুযায়ী এবং ফোটনের পোলারাইজেশনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বাধা হলো ডিকোহেরেন্স। আরেকটি বাধা হলো স্পিড। কিউবিটের সাথে বাহ্যিক দুনিয়ার যোগাযোগ যত শক্তিশালী হবে, “ক্লক স্পিড” ততই বাড়বে।
বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে গবেষণা চলছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার বেশ কিছু সম্ভাবনাময় পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে (যেমন- সুপারকন্ডাক্টিং সার্কিট, ট্র্যাপড আয়ন, সেমিকন্ডাক্টর কোয়ান্টাম ডট ইত্যাদি)। কিউবিটের কোহেরেন্স টাইম এক্সপোনেনশিয়ালভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার খুবই নিম্ন তাপমাত্রায় কাজ করে, তাই সাধারন তাপমাত্রায় (Room temperature) এটির কর্মক্ষমতা থাকে না। রুম টেম্পারেচারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বজায় রাখার জন্য বিজ্ঞানীরা Mothball ব্যবহার করার চিন্তা করছেন। ন্যাপথলিন পুড়িয়ে মথবল তৈরি করা হয়।
প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব), সহযোগিতায়: খায়রুন নাহার এবং মোঃ শাকিফ ফেরদৌস
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৭
জেডএম/