আম উৎপাদনে রয়েছে সপ্তম স্থানে। আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
এতো অর্জন সত্ত্বেও প্রতিকূলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কৃষি জমির উপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয় বরং গোটা বিশ্বের জন্য এক চিন্তার বিষয়।
জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করার জন্য ২০০৬ সালে বিশ্বে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করা হয়েছিল তার থেকে ৭০ শতাংশ বেশি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসলের ফলন ব্যাহত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলে বন্যার ফলে ধানের খেত তলিয়ে গিয়ে সেখানকার কয়েক লাখ কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাওরের মাছ, হাঁস মারা গিয়েছে। ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কৃষকদের দুর্দশা কমানোর জন্য প্রয়োজন এমন ধরনের প্রযুক্তি যা সহজেই এবং স্বল্প খরচে সমাধান দিতে সক্ষম। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও এখন পর্যন্ত ইন্টারনেট অব থিংসের যথার্থ ব্যবহার দেখা যায়নি। তবে এই সেক্টরে ইন্টারনেট অব থিংসের (IoT)প্রয়োগ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। কৃষিবিদরা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিজমি পর্যবেক্ষণের জন্য কৃষিক্ষেত্রে উপযোগী ড্রোন ব্যবহার করেছেন। জার্মানি থেকে কেনা এই ড্রোনগুলোতে হাই রেজোল্যুশন ক্যামেরা বসানো আছে যার মাধ্যমে ড্রোন কৃষি জমির ছবি তুলে তা কৃষিবিদদের কাছে পাঠাতে পারবে। বরিশাল এবং পটুয়াখালীর বিভিন্ন কৃষি জমি এই ড্রোনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে উন্নত দেশগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিক্ষেত্রে ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও কৃষিকাজে ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহার করা হচ্ছে যার ফলে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। কৃষি জমি বা ফার্মের ভেতরে তার বিছিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়, তাই ওয়্যারলেস বা তারবিহীন প্রযুক্তি এক্ষেত্রে অনেক উপকারে আসবে। ইন্টারনেট অব থিংসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যে এটি পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে – যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে এ ধরনের প্রযুক্তির বিভিন্ন ধরনের প্রয়োগ হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ান কোম্পানি তাসেল (Tassel) তাদের মৎস্য ফার্মে ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহার করে খরচ কমানোর সাথে সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। Tassel তাদের ফার্মে স্যামন মাছের চাষ করে। পানির গভীরে মাছের অবস্থা এবং পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করার জন্য পানির নিচে তারা স্মার্ট ক্যামেরা বসিয়েছে। এই ক্যামেরাগুলো তাদের সংগ্রহ করা তথ্য নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে পাঠায় যার মাধ্যমে সফটওয়্যারটি বুঝতে পারে যে ঠিক কোন সময়ে স্যামন মাছকে খাবার দেওয়া উচিত।
সঠিক সময়ে সফটওয়্যারটি খাবার ছাড়ে যার ফলে খাবারের ন্যূনতম অপচয় হয়।
অস্ট্রেলিয়ার আরেকটি ফার্ম কোম্পানি দি ইয়েল্ড (The Yield)মাইক্রোসফট এবং ইনটেলের মত কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করেছে মাইক্রোক্লাইমেট সেন্সিং সিস্টেম যা পরিবেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের পরিমাণ নির্ণয় করতে পারে। যেমন এটি ঝিনুক চাষিদের জন্য পানির লবণাক্ততা নির্ণয় করতে পারবে এবং ঝিনুক বের করার উত্তম সময় চাষিদেরকে জানাতে পারবে। ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এই সেন্সর চাষিকে আগেই জানিয়ে দিতে পারবে যে দূষিত পানি ফার্মের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। ফলে চাষি আগেই ঝিনুক বের করে ফেলতে পারবে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মাদেরা কাউন্টিতে বাদামের চাষ করেন বেশ কিছু চাষি। তাদের মাঝে অনেকেই ফার্মের বাদামের পরিচর্যার জন্য ইন্টারনেট অব থিংস এর ব্যবহার করেন। গোটা বাদাম বাগানের চারপাশে ময়েশ্চার সেন্সর বসানো হয়েছে যেগুলো ফার্মের মাটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। সেন্সরগুলো তাদের ফলাফল কম্পিউটারে পাঠায় এবং যেখান থেকে ডাটাগুলো পৌঁছে যায় ফার্মের সেচ ব্যবস্থার কাছে। ফলে ফার্মের হোস পাইপের মাধ্যমে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পৌঁছে যায় বাদাম বাগানে। সেই পানিতে পরিমাণ মত সার মেশানো থাকে। গোটা ব্যবস্থাটি মানুষের সাহায্য ছাড়াই নিজ থেকে কাজ করে যাবে। শুধু বাদাম চাষিরাই নন, আমেরিকার ভুট্টা এবং সয়াবিন ফার্মের চাষিরাও “স্মার্ট ফার্মিং” এর দিকে ঝুঁকছেন।
ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন টন দুধ উৎপন্ন হয়। সেখানকার গরুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে “স্মার্টমো” (SmartMoo) নামক একটি ইন্টারনেট অব থিংস ডিভাইস। এটি গরুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি দোহন করা, দুধের দাম নির্ণয় করা এবং দুধ ঠাণ্ডা করার মত কাজগুলোও করে দিতে সক্ষম। ইন্টারনেট অব থিংসের লক্ষ্য হলো প্রযুক্তিকে পরিবেশের সাথে মিশিয়ে দিয়ে মানুষের কাজ সহজ করে দেওয়া যাতে আমাদের জীবন হয়ে উঠে আরো আরামদায়ক। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য বজায় রাখতে হলে প্রয়োজন ইন্টারনেট অব থিংসের মত টেকসই প্রযুক্তি। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। একই সাথে মানুষ বেড়ে যাওয়ায় খাবারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সেক্টরে ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যবহার করে কৃষি জমি কমে যাওয়ার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান দেওয়ার জন্য এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে কৃষকদের জমি ও খামার নিরাপদ রাখার জন্য আধুনিক এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান বের করা সম্ভব।
প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ: সহযোগিতায় – মোঃ শাকিফ ফেরদৌস এবং খায়রুন নাহার।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, মে ৮, ২০১৭
জেডএম/