আজকের প্রযুক্তি-নির্ভর দুনিয়া ভাগ হয়ে গেছে বাস্তবে আর ভার্চুয়ালে। যে বাস্তব জগতে আমরা বাস করি, তারচেয়ে বহু বেশি মানুষকে আমরা চিনি ও যোগাযোগ করি অধরা-অদেখা-কাল্পনিক ভার্চুয়াল জগতে, যেখানে আমরা শারীরিকভাবে বসবাস করি না; করা সম্ভবও নয়।
বাস্তব পৃথিবীর বিপদ-আপদের মতো সাইবার জগতও সমস্যা সঙ্কুল। কল্পনার রূপকথা রাজ্য নয় মোটেই। তবে বাস্তব আর সাইবার জগতের বিপদ বা সমস্যার ধরন ও প্রকৃতি ভিন্ন। বিপদের গতিপথ এবং রূপ-প্রকৃতিও আলাদা। বাস্তবের জীবনের ভুলের কারণে মানুষ যেমনভাবে দণ্ডও শাস্তির সম্মুখীন হয়; সাইবার জগতেও তেমনই দণ্ড ও শাস্তির বিধান আছে। চরিত্রহরণ, মিথ্যাচার, উস্কানী ইত্যাদির জন্য রয়েছে তথ্য প্রযুক্তি অপরাধ নিয়ন্ত্রণের আইন ও শাস্তি। বাস্তবের আইনকে তোয়াক্কা না করেই অপরাধীরা দুষ্কর্ম ঘটায়; সাইবার জগতেও তেমনটি হচ্ছে। কক্সবাজারের রামুর সহিংস দাঙ্গার সূত্রপাত সাইবার জগত থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রদায়িক সমস্যার পেছনেও সাইবার জগতের ভূমিকা রয়েছে।
আবার বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার প্রতিরোধ ও নাগরিক অধিকার রক্ষার্থেও সাইবার জগত বিরাট ভূমিকা পালন করছে। ধর্ষণ বা অন্যবিধ অপরাধের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গঠনে সাইবার ক্ষেত্রটি বিরাট অবদান রাখছে। রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের পেছনেও সাইবার জগতকে পাওয়া যাচ্ছে তৎপর। সাম্প্রতিক সময়ে শাহবাগভিত্তিক গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে সাইবার জগতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রবল গুরুত্বপূর্ণ সাইবার জগতের ইতিবাচক ব্যবহারের পাশাপাশি নেতিবাচক বা ক্ষতিকর অপব্যবহারের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। মতলববাজরা পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। চরিত্রহনন, কুৎসা রটনা, গুজব ও তথ্য বিকৃতি ছাড়াও সাইবার সন্ত্রাসে নিমেষে লোপাট হয়ে যেতে পারে ব্যাঙ্কের জমানো আপনার কষ্টার্জিত টাকা; গোপন নথি। এলোমেলো হতে পারে কম্পিটারে রাখা ই-মেইল, বিভ্রান্তি ছড়ানো হতে পারে আপনাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আপনাকে ব্যবহার করে বা আপনার নাম ভাঙিয়ে অনাকাক্ষিত পরিস্থিতিও সৃষ্টি করতে পারে দুষ্টচক্র। আপনাকে জড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে অপরাধের সঙ্গে। অতএব এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাবধানতা অবলম্বন করাটা অতীব জরুরি।
সাইবার ক্রাইম বিষয়ক সমস্যাটি নিয়ে কথা বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যাপনা ও গবেষণারত কয়েকজন আইটি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তারা জানান, বর্তমানে অনেকেই ব্রডব্যান্ডের জন্য ওয়াই-ফাই ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন। সতর্ক না হলে হ্যাকাররা সেটা ব্যবহার করতে পারবে। এর থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো, যাকে দিয়ে আপনার নেটওর্য়াক ইন্সটল করিয়েছেন, তাঁকে বলবেন, আপনার নেটওর্য়াকটি যেন লুকনো থাকে। এবং সেটি যেন ডব্লিউপিএ-২ হয়। কখনও ডব্লিউইপি ব্যবহার করবেন না। এটা সহজেই হ্যাক করা যায়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কম্পিউটারের সঙ্গে সঙ্গে ফোনও সব সময় অনলাইন থাকে। সেখান থেকেও হতে পারে ‘আইডেনটিটি থেফ্ট’। ‘আইডেনটিটি থেফ্ট’ মানে যখন কেউ আপনার নাম, প্যান নম্বর বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর আপনার অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করতে পারে।
এসব ঠেকানোর প্রথম ধাপটি হলো, কখনওই ব্যক্তিগত বা গোপনীয় তথ্য ব্যবহার করবেন না। সাবধান থাকবেন কোনও রিকোয়েস্ট গ্রহণ বা কোন অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও। কম্পিউটার থেকে কোড বা তথ্য চুরি ঠেকাতে ‘ফায়ারওয়াল’ ইন্সটল করুন। এন্টি-ভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে এন্টি-ম্যালওয়ার প্রোগ্রামও ইন্সটল করুন। জোরদার ও জটিল পাসওর্য়াড ব্যবহার করুন। মাঝেমাঝে সেটার পরিবর্তন করুন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ই-মেইলে আসা কোনও অজানা ছবি বা লিঙ্কে ক্লিক করবেন না।
সাইবার সন্ত্রাস থেকে নিরাপদে থাকতে হলে বিশেষজ্ঞরা কিছু টিপস দিয়েছেন। যেমন, ডিকশনারি বা অভিধানের চেনা শব্দ দিয়ে পাসওর্য়াড তৈরি করবেন না। একই পাসওর্য়াড দুইবার ব্যবহার করবেন না। বিভিন্ন ওয়েবসাইটের জন্য আলাদা আলাদা পাসওর্য়াড ব্যবহার করুন। যত বড় পাসওর্য়াড হয়, তত ভালো। পাসওর্য়াডের দৈর্ঘ্য যত বড় হবে, সেটাকে ভাঙা বা হ্যাক করা ততই কষ্ট ও সময়সাপেক্ষ। স্বাভাবিকভাবে ১৪ বা তার বেশি ক্যারেক্টারের পাসওর্য়াড ভাঙা প্রায় অসম্ভব। গোপনে রাখুন পাসওর্য়াড। ইনবক্স বা ডেক্সটপে কখনওই রাখবেন না। আলাদা কাজে আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করুন। অর্থাৎ যে ওয়েব ব্রাউজার যেমন ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, মোজিলা ফায়ার ফক্স, গুগল ক্রোম ইত্যাদি দিয়ে এক একটি কাজ করুন। সামাজিক যোগাযোগ ও ব্যাঙ্কিং বা গোপন বিষয় একই ওয়েব ব্রাউজারে করবেন না। বিশেষ করে, বাসা-বাড়িতে অনেকেই একটি কম্পিউটার ব্যবহার করেন। বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে একই কম্পিউটারের বিভিন্ন সময়ে নিজেদের একাউন্টে কাজ করার সময় বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। যাতে অনধাবনতা বশত পাসওর্য়াড ফাঁস হয়ে না যায়।
বস্তুতপক্ষে বর্তমান যুগ শুধু বিশ্বায়নের যুগই নয়; সাইবার যুগও। সাইবার জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকার অর্থই হচ্ছে পৃথিবীতে যোগাযোগহীন থাকা। ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস, স্কাইপ, লিঙ্ক-ইন, ব্লগ তথা ভার্চুয়াল লাইফে যাকে পাওযা যায় না, তাকে অনুপস্থিতই ধরা হয়। মনে করা হয়, তিনি হারিয়ে গেছেন। যোগাযোগের জগতে টিকে থাকার প্রতিযোগিতাই চলতি সময়কারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য্। পাশাপাশি ব্যস্ততার কারণে অনেকেই কেনা-কাটা, ব্যাঙ্কিং, বিল প্রদানসহ অনেক কিছুই অন-লাইনের সারেন। সকল ক্ষেত্রেই নিজের তথ্য, হিসাব-পত্র, দলিলাদি গোপনে সংরক্ষণ রাখার চূড়ান্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
মনে রাখা দরকার, সাইবার জগতের অন-লাইন ভুবনে আমরা যত বেশি প্রবেশ করবো, ততই বেশি নানা ভাইরাস আর সন্ত্রাস বা প্রতারণাও আমাদেরকে চেপে ধরবে। সাইবার জগত ত্যাগ করে বর্ণবহুলবাবে জীবন-যাপন যেহেতু অসম্ভব, সেহেতু যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রতিষেধক নেওয়াই এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের জন্য সাইবার জগত ও অন-লাইন সম্পর্কের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সঙ্গে এর নানা সমস্যাগত দিক সম্পর্কেও অবহিত হতে হবে। ডিজিটাল যুগ, সাইবার জগত আর ভার্চুয়াল জীবন-যাপনের পথে প্রয়োজন তথ্যগত জ্ঞানভিত্তিক সতর্ক পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে নিজেকে সাইবার ক্রাইমের কবল থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে। নিত্যদিনের বাস্তবের জগতের মতোই সাইবার জগতের জন্যও প্রয়োজনীয় সতর্কতা আজকের বিশ্বব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, mahfuzparvez@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৭
জেডএম/