ম্যাককিন্সে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (MGI) এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, অন্য যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে কৃষিখাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার কম হয়। ডিজিটাল টেকনোলজির উপর কৃষকদের আস্থা কম হলেও এই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে অন্যান্য সেক্টরগুলো উন্নতি করছে এবং এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।
এ সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে। তারবিহীন বা ওয়্যারলেস প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে কৃষি ফার্মের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার দুশ্চিন্তা নেই এবং ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে সংযুক্ত ডিভাইসগুলো নিজ থেকেই কাজ করতে সক্ষম, তাই কৃষকদেরকে জটিলতার মুখে পড়তে হবে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কৃষি ফার্ম ইন্টারনেট অব থিংসের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে কৃষকরা তাদের কৃষিকাজের জন্য উপকারী তথ্য পাচ্ছেন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি ফার্ম ইতিমধ্যে ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছে। “তাসেল”(Tassel) তাদের মাঝে অন্যতম। অস্ট্রেলিয়ার “দি ইয়েল্ড” নামক কোম্পানি কৃষকদের জন্য তৈরি করছে ইন্টারনেট অব থিংসভিত্তিক বিভিন্ন প্রযুক্তি।
দি ইয়েল্ড (The Yield) ইন্টারনেট অব থিংস টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহারের উপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি তৈরি করছে যা খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকদের অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত কমিয়ে আনতে পারবে এবং কৃষকদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। দি ইয়েল্ডের প্রযুক্তি কৃষি খামারের পরিবেশের আবহাওয়া পরিমাপ করতে সাহায্য করে। একই সাথে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে আগামী কয়েক দিনের আবহাওয়া অনুমান করতেও সক্ষম। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে দি ইয়েল্ডের প্রযুক্তি কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
অস্ট্রেলিয়ার ঝিনুকচাষিদের জন্য দি ইয়েল্ড তৈরি করেছে এমন ইন্টারনেট অব থিংসভিত্তিক প্রযুক্তি যা ব্যবহার করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে খামারের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। ঝড় বা ভারী বৃষ্টিপাতের সময় পানি দূষণ এড়ানোর জন্য ঝিনুকচাষিরা চাষ বন্ধ করতে বাধ্য হন, যা চাষিদের জন্য বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি বয়ে আনে। এ ধরনের ক্ষতি কমিয়ে আনতে দি ইয়েল্ড তৈরি করেছে “ইন্টারনেট অব ওয়েস্টার” যা ব্যবহার করে চাষিরা চাষ বন্ধ করার সর্বোত্তম সময় জানতে পারবেন। রিয়াল-টাইম সেন্সর এবং অ্যাডভান্সড ডাটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে এই প্রযুক্তি ফার্মের পানির বিশুদ্ধতাও নির্ণয় করতে পারে। এই তথ্য থেকে চাষিরা জানতে পারেন যে ঝিনুকের পানি দূষিত হয়েছে কিনা। সেই সাথে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগ করে চাষ বন্ধ করার সঠিক সময় ৯৫% অ্যাকুরেসি নিয়ে প্রেডিক্ট করতে পারে। যার ফলে সঠিক সময়ের আগে চাষ বন্ধ করে চাষিদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া দি ইয়েল্ডের “ইন্টারনেট অব ওয়েস্টার” প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়ান ঝিনুক চাষিরা হার্ভেস্ট বা চাষে অপ্রয়োজনীয় বন্ধ ৩০% পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার অনেক ঝিনুক চাষি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন এবং এই ইন্টারনেট অব থিংসভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়ান ঝিনুক চাষিরা সম্মিলিতভাবে বছরে ৭.৬ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার অর্থ বাঁচাতে পারবেন।
ঝিনুক চাষের জন্য ব্যবহৃত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং প্রযুক্তি অন্যান্য খাদ্য এবং ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন জটিলতার সমাধান করতে পারে। এই লক্ষ্যে “ডাটা শেয়ারিং” বা তথ্যের আদান-প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে খামারের বা ফসলের বিভিন্ন তথ্য অন্যের সাথে শেয়ার করার ক্ষেত্রে অনেক কৃষকই দুশ্চিন্তায় পড়তে পারেন। কৃষকরা চিন্তা করবেন যে কারা তার খামারের বা ফসলের তথ্য নিতে পারবে এবং সেই তথ্য কিভাবে ব্যবহৃত হবে। তবে ডাটা শেয়ারিং এর মাধ্যমে কৃষকরা যে উপকৃত হবেন সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাসেলের মত অনেক কৃষি ফার্ম ইতিমধ্যে ডাটা শেয়ারিং করছে এবং ২০১৬ সালের অস্ট্রেলিয়ান ফার্ম ইন্সটিটিউট (AFI) এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের শেয়ার করা যৌথ ডাটাসেট থেকে কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন। যেমন: বিভিন্ন কৃষি জমির সয়েল সেন্সর এবং ক্রপ মনিটরিং সিস্টেমের ডাটা শেয়ার করে সেগুলো লোকাল ক্লাইমেট ডাটার সাথে সম্মিলিত করা হচ্ছে, যার ফলে ফসল উৎপাদনের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত তথ্য পাচ্ছেন কৃষকরা। কমনওয়েলথ ব্যাংক অ্যাগ্রি ইনসাইটস (Commonwealth Bank Agri Insights) অস্ট্রেলিয়ার ১৪০০ কৃষকের উপর এক জরিপ করেছে এবং সেখানে দেখা গেছে যে ৭৬% কৃষক ডাটা শেয়ার করাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং তাদের মাঝে ৫৮% কৃষক ইতিমধ্যে ডাটা শেয়ার করছেন।
ই-ভিলেজ প্রজেক্ট
কৃষি খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে “ই-ভিলেজ” নামক প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে। সেন্সরের মাধ্যমে ফসল বা সবজির ক্ষেত থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে তা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে।
“ই-ভিলেজ” নামক এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ফসলি জমির মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা যায়, ফসল সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে ফসলে কোন রোগ দেখা দিয়েছে কিনা তা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সাথে সাথেই জানা যায় এবং সেই সাথে অ্যাপ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে কৃষক তার উৎপাদন খরচ কমিয়ে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে পারবেন।
এই প্রজেক্টের আর্থিক সহায়তায় রয়েছে চীনা দূতাবাস। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আইটি ফার্ম আইসফটস্টোন(iSoftStone), বাংলাদেশের সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফর্মেশন(CRI) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের পাজুলিয়া গ্রামে এই প্রজেক্ট চালু করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৫ জন কৃষকের কাছে সেন্সর সম্বলিত ডিভাইস এবং স্মার্টফোন বিতরণ করা হয়েছে। এই ডিভাইসের মাধ্যমে পানির পিএইচ লেভেল জানা যাবে এবং ক্ষতিকারক পোকামাকড় আছে কিনা তা জানাতে পারবে।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডিভাইস তার প্রাপ্ত ডাটা সার্ভারে পাঠাতে থাকবে এবং সেখানে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিশেষজ্ঞ দ্বারা ডাটা বিশ্লেষণ করা হবে। ডাটা বিশ্লেষণের পর প্রাপ্ত ফলাফল এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ চলে যাবে কৃষকের অ্যাপে। ফলে কৃষক তার মোবাইল অ্যাপেই তার ফসলের অবস্থা এবং বিশেষজ্ঞ পরামর্শ পেয়ে যাবেন।
ই-ভিলেজ প্রজেক্টের বাস্তবায়নের ফলে প্রান্তিক কৃষকরা ৪০% পর্যন্ত আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, সহযোগিতায়-খায়রুন নাহার ও মোঃ শাকিফ ফেরদৌস
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৭
জেডএম/