ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

খবর তৈরিতে কৃত্রিম মেধা, থাকছে না সংবাদকর্মী!

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৩ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
খবর তৈরিতে কৃত্রিম মেধা, থাকছে না সংবাদকর্মী! কৃত্রিম মেধায় হবে সাংবাদিকতা

ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেছে। অভিষেকের পর এক বছর পার করেও ফেলেছে। বলা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে মিডিয়ার জন্য তথা সাংবাদিকতার জন্য রিপোর্টিংয়ে আর মানব সংবাদকর্মীর প্রয়োজন হবে না।

কৃত্রিম মেধা কাজটি করবে।  

নিউজ রাইটিং বটস নামের এই বিশেষ ব্যবস্থাটি মূলত হেলিওগ্রাফি।

যা যে কোন মানব সাংবাদিকের তুলনায় কয়েকগুন দ্রুততায় খবর লিখে ফেলতে পারে। এই ব্যবস্থায় খবরটিও হয় শতভাগ সঠিক। ‘হিউম্যান এরর’ বলে যে একটা কথা রয়েছে তাও থাকে না এই নিউজ রিপোর্টিং বটস তথা হেলিওগ্রাফির মাধ্যমে তৈরি করা প্রতিবেদনে।  

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও থেকে শুরু করে লস এঞ্জেলস টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট পর্যন্ত অনেকেই এই ব্যবস্থাকে নিজেদের করে নিয়েছে। চর্চাও করছে কম বেশি।  

আর ন্যারিটিভ সায়েন্সের কো-ফাউন্ডার ও সিটিও ক্রিশ্চিয়ান হ্যামোন্ড তো বলেই দিয়েছেন- আগামী ১৫ বছরের মধ্যে উন্নত বিশ্বের সংবামমাধ্যমের নিউজ আর্টিকেলগুলোর ৯০ শতাংশই লেখা হয়ে যাবে এই নিউজবটসের মাধ্যমে।  

বিষয়বস্তর সাথে ড্যাটা ও তার গানিতিক বিশ্লেষণকে সমন্বয় করে রিপোর্ট উপস্থাপনে সক্ষম এই হেলিওগ্রাফ নামের কৃত্রিম মেধা।  

নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনের কেভিন রুজ এর নাম দিয়েছেন স্বয়ংক্রিয় রিপোর্টিং। আর বলেছেন, আগামী সময়ের সাংবাদিকতায় সেরা দিকটি হয়ে থাকবে এই নিউজ রিপোর্টিং বটস।  

সংবাদমাধ্যমে এর ব্যবহারে অভিষেক হয় গত বছরে রিও ডি জেনেরোয় অলিম্পিক গেমস দিয়ে। খেলার স্কোরগুলোর দ্রুত রিপোর্ট করতে এর ব্যবহার করে ওয়াশিংটনপোস্ট। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো গত নভেম্বরে। তাতেও ভোটের ফলাফল নিয়ে রিপোটিংটি ওয়াশপোস্ট ব্যবহার করে হ্যালিগ্রাফি।

আর প্রযুক্তি যে গতিতে সামনের দিকে এগুচ্ছে ধীরে ধীরে গোটা রিপোর্টিং ব্যবস্থা এর আওতায় যেতে সময় লাগবে না বলেই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

আর্টিফিশিয়াল ইন্সলিজেন্স-ভিত্তিক এই হেলিওগ্রাফিকে তারা সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ব্যবহারের সবচেয়ে আধুনিক ও পরিশিলিত ব্যবস্থা বলেও উল্লেখ করছেন। এর মাধ্যমে সংবাদ যেমন দ্রুততর সময়ে প্রকাশ করা যায় তেমনি নিউজ স্টোরিটি অপেক্ষাকৃত ভালো হয় বলেও মত তাদের।

ওয়াশিংটন পোস্ট যখন গত রিও অলিম্পিকের খবরগুলো অটোপাবলিশ (স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশ) করে ফেললো তারপর তাদের আস্থা গেলো বেড়ে। এরপর আরও উন্নত ভার্সন ব্যবহার করে, আরও জোরদার সম্পাদকীয় ভাষা নিশ্চিত করে তারা প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন কাভারেজেও এর ব্যাপক ব্যবহার করলো।

হেলিওগ্রাফ সফটওয়্যারটি সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত চিহ্নিত করতে পারে। এবং সে তথ্য বা উপাত্ত দিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট টেমপ্লেটে প্রয়োজনীয় শব্দ, বাক্যাংশ এমনকি পূর্ণাঙ্গ অর্থপূর্ণ বাক্য গঠনে সক্ষম। ফলে ছোট করে হলেও রিপোর্টটি সাজিয়ে প্রকাশ করতেও পারে। যেমন: যুক্তরাষ্ট্রের গত প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন জিতে যাচ্ছিলেন এবং তার ইলেক্টোরাল ভোটের ব্যবধান যখন বাড়ছিলো, তখন নিউজবটস তথ্য বিশ্লেষণ করে লিখলো-‘ওয়াইডার মার্জিন দ্যান প্রেডিক্টেড’। যা সরাসরি সংবাদের ভাষা এবং প্রকাশযোগ্য।

লস এঞ্জেলস টাইমস'র কোয়াকবট ভূমিকম্পের খবর দেয় 

সুতারং ভবিষ্যতে স্কুপ রিপোর্টিং, কিংবা বড় রিপোর্টিংয়ের টিপ কিংবা পেগ দিতে এই হেলিওগ্রাফের তুলনা থাকবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই ব্যবস্থার অন্যতম দিকটি হচ্ছে এতে বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে দ্রুততার সাথে খবর পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে এতে শ্রমের ব্যবহার সামান্য। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে সংবাদকর্মীকে দিয়ে বড় রিপোর্ট প্রকাশের চেয়ে ছোট ছোট টার্গেট অডিয়েন্সের জন্য ছোট ছোট স্টোরি তৈরি করার সুযোগ রয়েছে এই হেলিওগ্রাফের মাধ্যমে। এতে খবরের সংখ্যা বাড়বে। ফলে সব মিলিয়ে পাঠক অনেক বেশি থাকবে।  

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিপন্ন সংবাদমাধ্যম বলা হচ্ছিলো ওয়াশপোস্টকে। নতুন এই ব্যবস্থা তাদের কিছুটা হলেও সুবিধা দিচ্ছে। পত্রিকাটির ডিজিটাল প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সিআইও এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট শৈলেশ প্রকাশ বলেন, যেখানে প্রযুক্তির সহায়তা মিলবে সেখানে মানব ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। আর সে সক্ষমতাও আমাদের নেই। করতে গেলে দেউলিয়া হতে হবে।  

তবে স্ট্রাজেজিক ইনিশিয়েটিভ বিভাগের পরিচালক জেরেমি গিলবার্ট বলছেন, রোবটে লেখা ছোট ছোট স্টোরিকে আমরা গুরুত্ব দেবো এটা ঠিক, তবে সাংবাদিকরা এখনই কাজ হারাচ্ছেন না। তারা মজাদার, জটিল স্টোরির খোঁজ করবেন ও লিখবেন।  

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসও মানব দক্ষতা ও সক্ষমতার উর্ধে রয়েছে এমন স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষণও তুলে আনছে এই হেলিওগ্রাফের মাধ্যমে। কোম্পানিগুরোর আয় প্রতিবেদন তৈরির জন্য এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর প্রতি তিন মাসে এই পদ্ধতিতে ৩৭০০ করে এ ধরনের খবর তৈরি করছে এপি। যা তাদের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তৈরি ওই ধরনের খবরের চেয়ে ১২ গুন বেশি। আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সংবাদকর্মীরা প্রতি কোয়ার্টারে মাত্র ৩০০টি কোম্পানির আয় প্রতিবেদন তৈরি করতে পারতেন। এতে হাজার হাজার কোম্পানির রিপোর্ট তৈরি করাই হতো না।

সংবাদপত্র হিসেবে প্রথম হলেও মেশিন-ভিত্তিক সংবাদ তৈরিতে ওয়াশপোস্টই প্রথম নয়। এর আগে শিকাগোভিত্তিক কোম্পানি ন্যারেটিভ সায়েন্স বেসবল খেলার স্কোর দিয়ে খবর তৈরি করতে শুরু করে। এখন এই কোম্পানিটি আয়ের প্রতিবেদন এবং রিয়েল স্টেটের তালিকা তৈরির কাজও করছে এই কৃত্রিম ব্যবস্থায়।

এছাড়াও লস এঞ্জেলস টাইমস কোয়াকবট নামে একটি সফটওয়্যার বানিয়ে ব্যবহার করছে যার মাধ্যমে ভূমিকম্প বিষয়ক ব্রেকিং নিউজ তৈরি ও প্রকাশ করছে বেশ কিছুদিন ধরে সর্বোচ্চ দ্রুততায়।  

এনপিআর এরই মধ্যে এমন বট ব্যবহার করে ডাইনার চেইন ডেনি’র কোয়ার্টালি আয়ের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। আর ওয়্যারড তার নিউজবট দিয়ে অটোমেটেড ইনসাইট’র উধ্বতন কর্মকর্তা মারভিন মিনকসির শোক সংবাদ লিখে প্রকাশ করেছে।

তাহলে কী ধীরে ধীরে কৃত্রিম মস্তিষ্কই দখল করে নেবে আজকের সাংবাদিকতা?

বাংলাদেশ সময় ১২২৭ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
এমএমকে   

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।